ঢাকা : সিরিয়ার একমাত্র বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত প্রদেশ ইদলিব নিয়ে তুরস্ক এবং সিরিয়ার মধ্যে এখন কার্যত যুদ্ধ চলছে। যে কোনো মুহূর্তে রাশিয়া এই যুদ্ধে তুরস্কের প্রতিপক্ষ হয়ে যেতে পারে- এই আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। ইদলিবে গত কদিনের হামলা পাল্টা হামলায় সিরিয়া এবং তুরস্ক দুপক্ষেরই ক্ষয়ক্ষতি প্রাণহানি হয়েছে।
বুধবার (৪ মার্চ) তুরস্ক তাদের দুজন সৈন্যের নিহত হওয়ার খবর স্বীকার করেছে। এ নিয়ে ইদলিবে নিহত তুর্কি সৈন্যের সংখ্যা সরকারি হিসাবেই ৫০ ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে তুরস্ক সিরিয়ার তিনটি যুদ্ধবিমান গুলি করে নামিয়েছে এবং দাবি করেছে তাদের হামলায় ছয়শরও বেশি সিরিয় সৈন্য এবং শিয়া মিলিশিয়া মারা গেছে।
এখনও তুরস্ক সিরিয়ায় সরাসরি রুশ সৈন্য বা রুশ যুদ্ধ বিমান টার্গেট করেনি, কিন্তু পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে তেমন ঘটনা মাত্র সময়ের ব্যাপার বলে সামরিক বিশ্লেষকদের অনেকেই আশঙ্কা করছেন।
ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইন্সটিটিউট অব ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের বিশ্লেষক কোনোর ডিলিন বলছেন, তুরস্ক এবং রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরুর ঝুঁকি এখন প্রবল। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব প্রকাশনা 'ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট' সাময়িকীতে মি. ডিলিন লিখেছেন, ‘রেচেপ তাইয়িপ এরদোয়ান এবং ভ্লাদিমির পুতিন ইদলিবে ভয়ঙ্কর খেলায় মেতেছেন। দুজনেরই সেখানে ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ রয়েছে এবং সেগুলো চরিতার্থ করতে কেউই পিছু হটতে রাজী বলে মনে হচ্ছেনা।’
তুরস্ক নেটো জোটের সদস্য এবং সৈন্য সংখ্যার বিচারে জোটের সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তি। তবে পারমানবিক শক্তিধর রাশিয়ার সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি সম্পর্কে তুরস্ক ওয়াকিবহাল। সে কারণেই হয়ত প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে মুখোমুখি কথা বলতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান আগামিকাল (বৃহস্পতিবার) মস্কো যাচ্ছেন যাতে ইদলিবের সংঘাত আয়ত্তের বাইরে না চলে যায়।
বুধবার আঙ্কারায় ক্ষমতাসীন একে পার্টির সদস্যদের এক সভার পর মি. এরদোয়ান বলেন, মস্কোতে গিয়ে তিনি ইদলিবে দ্রুত একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য চেষ্টা করবেন।
তবে ইদলিবে তুরস্কের সামরিক তৎপরতায় তারা যে কতটা নাখোশ তা খোলাখুলি জানিয়েছে মস্কো। মি এরদোয়োনের মস্কো সফরের আগের দিন রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে খোলাখুলি বলেছে, ইদলিবে তুরস্কের সৈন্যদের সাথে জিহাদি বিদ্রোহীদের সখ্যতা এবং সহযোগিতা আরো দৃঢ় হচ্ছে।
মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মেজর- জেনারেল ইগর কোনাশেনকভ বলেছেন, তাহরির আল শামস বা হুররা আল দিনের মত যে সব গোষ্ঠীকে জাতিসংঘ সন্ত্রাসী হিসাবে বিবেচনা করে, তারাই এখন ইদলিবে তুরস্কের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে তুর্কি সৈন্যদের সাথে মিলে সামরিক তৎপরতা চালাচ্ছে।
জেনারেল কোনাশেনকভ বলেন, সিরিয়ার হেমেইমে রুশ বিমান ঘাঁটিতে ব্যাপকহারে কামানের গোলাবর্ষণ এখন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া বলছে, সিরিয়ার ভেতরে তাদের যান্ত্রিক বহরের বিপুল সমাবেশ ঘটিয়ে তুরস্ক আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। তাছাড়া, রাশিয়া বলছে, নেটো জোটের হস্তক্ষেপের লক্ষ্যে ইদলিবে ১০ লাখের মত শরণার্থী তৈরি হয়েছে বলে যে দাবি তুরস্ক করছে তা মিথ্যা প্রচারণা। মস্কোর বক্তব্য - তিন বছর আগে শরণার্থীর ছবি ব্যবহার করেছে তুরস্ক।
এরদোয়ান কি রণে ভঙ্গ দেবেন?
বৃহস্পতিবার মস্কোতে মি. এরদোয়ানকে এসব অভিযোগের কথায় হয়তো তুলে ধরবেন মি. পুতিন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাতে কি ভড়কে যাবেন মি.এরদোয়ান? আঙ্কারা থেকে যেসব ইঙ্গিত এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে, তাতে মনে হয়না তুরস্ক সহজে রণে ভঙ্গ দেবে।
বিশেষ করে ইদলিবের সারাকেব শহরে সিরিয়ার এক হামলায় ৩৩ জন তুর্কি সৈন্যের মৃত্যুর ঘটনায় ক্রোধে টগবগ করে ফুটছে তুরস্ক। একটি হামলায় এত প্রাণহানি তুর্কি সেনাবাহিনীতে গত ৩০ বছরে হয়নি। প্রতিদিনই তুরস্কের সরকার-সমর্থিত মিডিয়াগুলোতে সিরিয়ায় বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর আহ্বান জানানো হচ্ছে।
এমনকি বিরোধী রিপাবলিকান পিপলস পার্টির নেতা কেমাল কিলিচদারোগোলু বলেছেন, ‘যে দেশই আমার সৈন্যের গায়ে হাত দেবে, তারাই শত্রু।’ তিনি রাশিয়াকেই ইঙ্গিত করেছেন। সরকার সমর্থক এমএইচপি দলের নেতা দেভলেত বাচেলি বলেছেন, ‘এখনই দামেস্ক ঢুকে আসাদের মাথায় টুপি চাপিয়ে দিতে হবে।’
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান গত বেশ কিছুদিন ধরে নেটোর সমালোচনা করলেও, এখন তিনি তাদের দ্বারস্থ হয়েছেন। আমেরিকান কর্মকর্তারাও দফায় দফায় আঙ্কারায় যাচ্ছেন বলে সংবাদদাতারা জানাচ্ছেন। মার্কিন সেনাবাহিনীর ইউরোপীয় কম্যান্ডের প্রধান জে টড ডি গত মাসে আঙ্কারায় গিয়ে সিরিয়ায় সহযোগিতা নিয়ে কথা বলেছেন।
এছাড়া, গত মাসে ইউক্রেন সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, ক্রাইমিয়া সহ ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বকে তুরস্ক সবসময় সমর্থন করবে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর জন্য তিনি ২০ কোটি ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন। মি.এরদোয়ানের এসব কথাবার্তায় ক্ষিপ্ত হয়েছে রাশিয়া এবং রুশ রাজনীতিকরা তা প্রকাশ করতে দ্বিধা করছেন না। মস্কো মনে করছে, মি. এরদোয়ান রাশিয়ার ওপর চাপ তৈরির চেষ্টা করছেন।
কিন্তু রাশিয়া কি ইদলিব পুনর্দখলের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে পারে? ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ রুশ রাজনীতিক সের্গেই মারকভ রয়টরস বার্তা সংস্থাকে বলেছেন, ‘রাশিয়া শক্ত অবস্থান নিয়েছে এবং যে কোনো লড়াইতে তারা প্রস্তুত।’
জানা গেছে ইদলিবের সারাকেভ শহরে রাশিয়া তাদের সামরিক পুলিশ মোতায়েন করেছে। তারা দেখতে চাইছে তুরস্ক এরপরও সেখানে হামলা করে কিনা। মি মারকভ বলছেন, ‘সারাকেবের ওপর যে কোনো হামলা হবে রাশিয়ার ওপর হামলা।’
গত সপ্তাহে ভূমধ্যসাগরে ক্রুজ মিসাইল বহনকারী নতুন যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে রাশিয়া। ইদলিব থেকে বিদ্রোহীদের হটিয়ে দ্রুত সিরিয়ার যুদ্ধ শেষ করতে উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। কিন্তু তুরস্কের কাছে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কৌশলগত মূল্য অনেক। এদেরকে তারা কুর্দিদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে চায়। ফলে বৃহস্পতিবার মি. এরদোয়ান এবং মি. পুতিনের বৈঠকে ইদলিব নিয়ে সৃষ্ট সংকটের সমাধান হবে- এমন আশা কেউ করছেন না।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
আগামীনিউজ/সবুজ