ঢাকাঃ জর্ডানে ড্রোন হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের তিন সেনা। হামলায় আহত হয়েছেন আরও ৪০ সেনা সদস্য। সিরিয়া সীমান্তবর্তী জর্ডানের একটি সামরিক ঘাঁটিতে হওয়া সেই হামলার প্রতিক্রিয়া এখন জানাতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে।
ওয়াশিংটন এই হামলার জবাব দেওয়ার কথা জানিয়েও রেখেছে। তবে সেটি কীভাবে হবে? আর জর্ডানের ঘাঁটিতে হওয়া এই আক্রমণের প্রতিক্রিয়া জানাতে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ঠিক কী বিকল্প আছে?
মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এগুলো নিয়েই আলোচনা করেছে।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ওয়াশিংটন এখন একটি উভয়সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। জর্ডানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে গত রোববারের ভয়াবহ হামলার কঠোর জবাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখন যে চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে তা হলো- প্রতিরোধ এবং উত্তেজনার আরও বৃদ্ধির মধ্যে সঠিক ভারসাম্য খুঁজে বের করা।
গত রোববারের হামলার জবাবে কঠোরভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে ব্যর্থ হলে সেটি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতার বার্তাই অন্যদের কাছে প্রেরণ করবে। আর সেটি কেবলমাত্র (মার্কিন বাহিনীর ওপর) আরও আক্রমণ চালাতে অন্যদের উৎসাহিত করবে। আবার খুব কঠোর কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা ইরান এবং তার মিত্রদের কাছ থেকেও ক্রমবর্ধমান প্রতিক্রিয়া বের করে আনতে পারে।
আর তাই জর্ডানের ঘাঁটিতে হওয়া এই আক্রমণের প্রতিক্রিয়া জানাতে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে অপশন কি আছে? এবং কিভাবে সেই অপশনগুলো কাজ করবে?
বিবিসি বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইতোমধ্যেই বেছে নেওয়ার জন্য ‘অন-দ্য-শেল্ফ’ সামরিক বিকল্প বা অপশন রয়েছে। সিআইএ এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর এগুলো প্রস্তুত করেছে। তারপরে এগুলো মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ এবং নীতিনির্ধারকদের কাছে উপস্থাপন করা হয়। এরপর প্রেসিডেন্ট চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন এবং নির্বাচিত অপশনটিতে অনুমোদন দেন।
অপশন ১: ইরানের-মিত্রদের ঘাঁটি এবং কমান্ডারদের ওপর হামলা
এটি সবচেয়ে সুস্পষ্ট পছন্দ এবং অতীতে ব্যবহৃত হয়েছে। ইরাক ও সিরিয়াজুড়ে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের অগণিত সংখ্যক ঘাঁটি, অস্ত্রের গুদাম এবং প্রশিক্ষণ ডিপো রয়েছে। এই মিলিশিয়ারা ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডস কর্পসের (আইআরজিসি) কুদস ফোর্সের হাতে প্রশিক্ষিত, সজ্জিত। এছাড়া তারাই এগুলোর অর্থায়ন করে। কিন্তু তারা সবসময় আইআরজিসির মাধ্যমে পরিচালিত হয় না।
যুক্তরাষ্ট্র জানে তারা কারা এবং তারা কোথায় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। তাই যুক্তরাষ্ট্র সহজেই এই ঘাঁটিগুলোতে আরও নির্ভুল-নির্দেশিত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালাতে পারে। তবে এই ধরনের হামলা এখনও পর্যন্ত মিলিশিয়াদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে এই অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে ১৭০ টিরও বেশি আক্রমণ চালিয়েছে মিলিশিয়ারা।
এছাড়া সামরিক ঘাঁটিতে হামলার দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স ইন ইরাক নামে একটি গ্রুপ।
মূলত ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের বেশ কয়েকটি গোষ্ঠীকে একত্রিতভাবে বোঝাতে এই নামটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যার মধ্যে কিছু গোষ্ঠী আবার অপ্রত্যাশিত ভাবে এই অঞ্চলে সবার অভিন্ন শত্রু ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে থেকে লড়াই করেছে।
এছাড়া এসব গোষ্ঠীর ইরানের মতো অভিন্ন লক্ষ্যও রয়েছে। যেমন ইরাক এবং সিরিয়া থেকে মার্কিন সামরিক বাহিনীকে তাড়ানো এবং ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা ও সমর্থনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে শাস্তি দেওয়া।
অপশন ২: ইরানে হামলা করা
সরাসরি ইরানে হামলা করা হলে তা উত্তেজনা ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেবে এবং এই ধরনের অপশন কার্যত এমন কিছু নয় যা যুক্তরাষ্ট্রও হালকাভাবে বিবেচনা করবে। এটি অত্যন্ত অসম্ভাব্য হলেও অকল্পনীয় নয় যে, প্রতিশোধ নিতে ইরানের সার্বভৌম ভূখণ্ডে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
ওয়াশিংটন বা তেহরান কেউই পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে নামতে চায় না এবং উভয়েই তা বলেছে। (যুদ্ধ শুরু হলে) ইরান অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার চেষ্টা চালাতে পারে, যার মাধ্যমে বিশ্বের ২০ শতাংশ তেল ও গ্যাস সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
আর এটি বিশ্ব অর্থনীতিতে বিধ্বংসী প্রভাব ফেলবে, তেল ও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেবে এবং আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে জো বাইডেনের পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনাকে প্রায় নিশ্চিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
অবশ্য আরেকটি বিকল্প হতে পারে ইরাক বা সিরিয়ায় থাকা ইরানের সিনিয়র আইআরজিসি কমান্ডারদের ওপর হামলা করা। এই ধরনের ঘটনার নজিরও অবশ্য রয়েছে। চার বছর আগে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে বাগদাদে আইআরজিসি কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সুলেইমানিকে হত্যা করেছিল মার্কিন বাহিনী।
তবে এমন কিছু আবারও হলে তা উত্তেজনার ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটাবে এবং হতে পারে তেহরানের কাছ থেকেও পাল্টা কোনও বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়া আসতে পারে।
অপশন ৩: কোনও জবাব বা প্রতিক্রিয়া না দেখানো
বিবিসি বলছে, মার্কিন প্রশাসন ও ক্ষমতাবলয়ের মধ্যে এমন কিছু ব্যক্তি আছেন যারা যুক্তি দেন, মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে, বিশেষ করে (যুক্তরাষ্ট্রে) নির্বাচনের বছরে ইরানের স্বার্থে আঘাত করা ওয়াশিংটনের জন্য দায়িত্বজ্ঞানহীন হবে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের অংশ হিসেবে সেন্টকম মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক তৎপরতা চালিয়ে থাকে। তারা ইতোমধ্যেই লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগরে জাহাজে হুথিদের দফায় দফায় আক্রমণের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে বিস্তৃত পরিসরে সংঘাতের সূত্রপাত না করার জন্য এই অঞ্চলের চারপাশে থাকা মার্কিন মিত্রদের কাছ থেকে অনুরোধও শুনতে হতে পারে ওয়াশিংটনকে।
কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গিটি সম্ভবত তাদের কাছে টিকবে না যাদের মত হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা নীতি ব্যর্থ হয়েছে এবং যারা মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালাচ্ছে তাদের কঠোর জবাব দিতে ওয়াশিংটনের অনিচ্ছা তাদের আক্রমণ আরও বাড়াতে উৎসাহিত করেছে।
এই সবের মধ্যে একটি সময় ফ্যাক্টরও রয়েছে। কেউ কেউ যুক্তি দেবে, বড় ধরনের মার্কিন সামরিক প্রতিক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদে প্রয়োজনীয় বা সার্থক নাও হতে পারে।
প্রথমত, গাজায় ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের আগে থেকেই ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের আক্রমণ চলছিল। কিন্তু গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে এই ধরনের হামলা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
গাজায় ইসরায়েলের হামলা শেষ হলে এই অঞ্চলে উত্তেজনা ভালোভাবে কমে যেতে পারে। যদিও ইসরায়েল সতর্ক করে বলেছে, গাজায় তাদের আগ্রাসন আরও কয়েক মাস চলতে পারে।
দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পদচিহ্ন কমানোর জন্য ওয়াশিংটন থেকেই কেউ কেউ বেশ প্রবল আহ্বান জানিয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন সিরিয়া থেকে সমস্ত মার্কিন বাহিনীকে প্রত্যাহার না করতে তাকে রাজি করিয়েছিল তার সামরিক ও গোয়েন্দা প্রধানরা। মূলত আইএসআইএসের ফিরে আসা থেকে আটকাতে সিরিয়ায় কুর্দি বাহিনীকে সাহায্য করছে মার্কিন বাহিনী।
আর তাই শক্তিশালী একটি সম্ভাবনাও রয়েছে যে, ট্রাম্প যদি এক বছরের মধ্যে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসেন এবং ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি কমানোর সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে ইরান যেভাবেই হোক তার পথ পেয়ে যাবে।
এমআইসি/