ঢাকাঃ ব্রডব্যান্ডের তুলনায় ১১ গুণ গ্রাহক মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করলেও এর মূল্য নির্ধারণের উদ্যোগ ঝুলে আছে দীর্ঘদিন। অথচ দেশে মোবাইলফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ অস্বাভাবিক, সেবার মানও তলানিতে। রয়েছে নানা প্যাকেজের মারপ্যাঁচ। এসব বিষয় সমাধান না করে সম্প্রতি ‘এক দেশ এক রেট’ নামে ব্রডব্যান্ড ইন্টানেটের মূল্য নির্ধারণ করেছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। এতে বেশির ভাগ গ্রাহকের স্বার্থকে পাশ কাটানো হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
বিটিআরসির সর্বশেষ প্রতিবেদন (এপ্রিল ২০২১) অনুযায়ী, দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ৫৪ লাখ। এর মধ্যে মাত্র ৯৮ লাখ মানুষ ব্রডব্যান্ড সংযোগের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। বাকি ১০ কোটি ৫৬ লাখ গ্রাহকই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন মোবাইলফোনে। কিন্তু গত ৬ জুন সারাদেশে প্রান্তিক পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। তাতে ইন্টারনেটের গতিসীমাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়। আগামী জুলাই থেকে এ ট্যারিফ রেট কার্যকর হওয়ার কথা।
অথচ দীর্ঘদিন ধরেই মোবাইলফোনে ইন্টারনেটের দাম ও মান নিয়ে চরম অসন্তুষ্ট গ্রাহকরা। এ জন্য ২০১৭ সালে কস্ট মডেলিং বা মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়াও শুরু করেছিল বিটিআরসি। তবে আজ পর্যন্ত সেটি আলোর মুখ দেখেনি। গত এক যুগে প্রতি এমবিপিএস ব্যান্ডইউথের দাম ১ লাখ ২৭ হাজার টাকা থেকে দফায় দফায় কমিয়ে মাত্র ২৮৫ টাকা করা হয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় প্রান্তিক ব্যবহারকারীরা তেমন সুফল পায়নি।
মোবাইলফোনে ইন্টারনেটের মূল্য নির্ধারণ হবে কবে- এমন প্রশ্নের জবাবে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, এ মুহূর্তে দিনক্ষণ ঠিক করে বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা কাজ করছি। এখন ব্রডব্যান্ডের দাম ঠিক করে দিয়েছি। আগে সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি বলেন, ব্রডব্যান্ডের গ্রাহক সংখ্যা কম হলেও দেশের মোট ব্যবহৃত ব্যান্ডউইথের ৫৮ শতাংশ ব্যবহার করেন তারা। বাকি ৪২ শতাংশ ব্যান্ডউইথ ব্যবহারিত হয় মোবাইলে।
ইন্টানেটের দাম বেশি থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আপনি যদি একটি দিনমজুরের ক্যাপাসিটি থেকে দেখেন, তাহলে ইন্টারনেটের দাম একটু বেশি মনে হবে। আর যদি উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করেন, তবে দেখবেন- দাম বেশি না। এখানে সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। এটা নির্ভর করে অনেক বিষয়ের ওপর। এর মধ্যে ব্যবহারকারীর ডিভাইসও গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা কম দামে ভালো দেশীয় মোবাইল সেট বাজারে সহজলভ্য করার চেষ্টা করছি।
দাম বেশি গতি কম: ইন্টারনেট সেবার মূল্য সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণকারী যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কেবল ডট কো ডট ইউকের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ৩০ দিন মেয়াদি ১ গিগাবাইট ইন্টারনেট ডেটার মূল্য গড়ে ৭০ সেন্ট (সাড়ে ৫৯ টাকা)। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এ সেবার গড় মূল্য মাত্র ৯ সেন্ট (৭ টাকা ৬৫ পয়সা)। আবার গতির হিসেবেও বাংলাদেশের মোবাইল ইন্টারনেটের অবস্থা খারাপ। ২০২১ সালে জানুয়ারিতে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওকলার তথ্যমতে, বিশ্বের ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৬তম। মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় মোবাইল ইন্টারনেটের গতি বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে অনেক বেশি।
এ প্রসঙ্গে জার্মানভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সাইনপালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী সাইফ সাইফুল্লাহ বলেন, মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছাতে আইআইজি, এনটিটিএন, টাওয়ার, স্পেকট্রাম, কর ও শুল্কসহ বিভিন্ন খরচ যুক্ত হয়। সেখানে শৃঙ্খলা না আনা গেলে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের দাম কমবে না। তিনি বলেন, অদূর ভবিষ্যতে মানুষ মোবাইলে কথা বলার চেয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করবেন বেশি। এখনো মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ও আর্থিক লেনদেন এ খাতে বেশি। তাই ব্রন্ডব্যান্ডে বেশি ব্যান্ডউইথ ব্যবহারিত হলেও আগে মোবাইল ইন্টারনেটের মূল্য নির্ধারণ করা উচিত ছিল। তাতেই বেশির ভাগ মানুষের স্বার্থ রক্ষা হতো বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিটিআরসির ব্যর্থতা দায়ী: মোবাইলফোনে ইন্টারনেটের দাম নির্ধারণ না করার পেছনে বিটিআরসির ব্যর্থতা দায়ী বলে মনে করেন মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ। তার মতে, বর্তমানে মোবাইলফোন অপারেটরদের যে পরিমাণ স্পেকট্রাম বা তরঙ্গ রয়েছে তা দিয়ে ভালোমানের ফোরজি ও ইন্টারনেট সেবা দেয়া সম্ভব নয়। মোবাইল ফোন অপারেটরদের যেখানে অন্তত ১০০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ দরকার, সেখানে গড়ে রয়েছে ৩৯ দশমিক ১৫ মেগাহার্জটজ। তিনি বলেন, এখানে অনেক মধ্যসত্ত্বভোগী রয়েছে। প্রত্যেকেই নিজেদের মতো মুনাফা করছে। মাত্র ২টি এনটিটিএন প্রতিষ্ঠান মাঠ দখলে রেখেছে। বিটিআরসি নিজেই এসব সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, সংস্থাটি নিলামের সময় স্পেকট্রামের যে ভিত্তিমূল্য ধরে, সেটি অস্বাভাবিক। সবশেষ নিলামে ৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ ব্লকের মূল্য বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে। কারণ, গ্রাহক ও রাজস্ব আদায়ের আনুপাতিক বিচারে এটি সর্বোচ্চ। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত বিটিআরসি ২৩০০ ও ২৬০০ মেগাহার্টজের তরঙ্গ মোবাইল অপারেটরদের বরাদ্দ করতে পারেনি। এসব কারণে সংস্থাটি মোবাইল ফোনে ইন্টারনেটের দাম কমানোর পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
প্যাকেজের মারপ্যাঁচে ঠকছে গ্রাহক: এমনিতেই মোবাইল ইন্টারনেটের ১০০ টাকা রিচার্জে কর ও শুল্ক বাবদ গ্রাহকদের ২১ টাকা ৭৫ পয়সা চলে যায় সরকারি খাতায়। এর ওপর বিভিন্ন কোম্পানির ইন্টারনেট প্যাকেজের মধ্যে রয়েছে নানা মারপ্যাঁচ। ৪৯ টাকায় রবির ৩০ দিন মেয়াদি ১ গিগাবাইটের (জিবি) যে অফারটি রয়েছে তাতে দেখা গেছে, শুধু ইউটিউব, টিকটক ও লাইকির সাইটে প্রবেশ করা যাবে। ফেসবুক ও ম্যাসেঞ্জারে ঢুকতে হলে কিনতে হবে আলাদা প্যাক। আবার ইমো ব্যবহারের জন্যও আলাদা ৪৯ টাকা খরচ করতে হবে গ্রাহককে। একই ধরনের অফার রয়েছে গ্রামীণফোন ও বাংলালিংকেরও। অনেক অফারে বেশি ডেটা খুব কম মেয়াদে দেয়া হচ্ছে। বাংলালিংকের ২৩ টাকায় ৩ দিন মেয়াদি ৫১২ মেগাবাইটের (এমবি) একটি অফার রয়েছে। এতে প্রতি এমবির খরচ পড়ে প্রায় ৪ পয়সা। আর একই মেয়াদে ৮৯ টাকায় তাদের আরেকটি অফার রয়েছে ৮ জিবির। সে হিসেবে প্রতি এমবির খরচ পড়ে ১ পয়সা। খরচ কম ভেবে অনেকে ৮৯ টাকার অফারটি কেনেন। কিন্তু ৩ দিনে ৮ জিবি খরচ করতে পারেন না। মাঝখান থেকে কোম্পানিটির রাজস্ব আয় বেশি হয়। গ্রামীণফোনের ভলিউম, বায়োস্কোপ, কনফারেন্স প্রভৃতি নামে ইন্টারনেট প্যাকেজ রয়েছে। সেখানে মাত্র ৯ টাকায় ৩০ এমবির একটি বায়োস্কোপ প্যাক রয়েছে যার মেয়াদ ৩ দিন। কিন্তু ৩০ এমবিতে একটি সিনেমা পুরোপুরি দেখা যায় কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। না বুঝে গ্রাহক এ প্যাকটি কিনে প্রথম ধাক্কাতেই ধোঁকা খান। পরে সিনেমাটি শেষ করার জন্য তাকে ৫২ টাকা দিয়ে ৫ জিবির অফারটি কিনতে হয়।