ঢাকাঃ বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং মৃত্যুহার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। চলতি বছরে বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রমণ, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা এবং মৃত্যুহার গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। এজন্য মশার বংশবিস্তারে বাংলাদেশের অনুকূল পরিবেশকে দায়ী করেছে সংস্থাটি।
শুক্রবার (১১ আগস্ট) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত সেখানে ৬৯ হাজার ৪৮৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। এ সংক্রান্ত মৃত্যু হয়েছে ৩২৭টি। যার মধ্যে ৬২ শতাংশ শনাক্ত এবং ৬৩ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে জুলাই মাসে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুহার বেড়ে ০.৪৭ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত ৫ বছরের তুলনায় অনেক বেশি।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, যদিও বাংলাদেশে ডেঙ্গু মহামারী, কিন্তু বর্তমান ডেঙ্গুর বৃদ্ধি অস্বাভাবিক এবং আগের বছরগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। এই ঢেউ শুরু হয়েছিল জুনের শেষের দিকে। আগের বছরের তুলনায় এই বছর এখন পর্যন্ত মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে বেশি। প্রাক-বর্ষা মৌসুমে এডিস মশার জরিপে দেখা যায় যে, মশার ঘনত্ব এবং সম্ভাব্য হটস্পটের সংখ্যা গত পাঁচ বছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। উচ্চ তাপমাত্রা এবং উচ্চ আর্দ্রতা, অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের প্রেক্ষাপটে কারণে সারা বাংলাদেশে মশার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ডব্লিউএইচও এর তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে চলতি বছর ২০২৩ সালের মে মাস থেকে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর অস্বাভাবিক বিস্তার শুরু হয়েছে যা এখনও অব্যাহত আছে। ২০০০ সাল থেকে রেকর্ড করা তথ্য অনুযায়ী একই সময়ের তুলনায় চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ।
ডেঙ্গুর লক্ষণ
ডেঙ্গু আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে মাঝারি অথবা কোনো লক্ষণই দেখা যায় না এবং তারা দুই সপ্তাহের মধ্যে সেরে ওঠেন, তবে ডেঙ্গু মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে এবং এ কারণে মৃত্যু হতে পারে। যদি লক্ষণ দেখা যায়— তাহলে সেটি সাধারণত আক্রান্ত হওয়ার ৪ থেকে ১০ দিনের মধ্যে দেখা দেয় এবং এগুলো অন্তত দুইদিন বা সাতদিন পর্যন্ত থাকতে পারে।
ডব্লিউএইচওর তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুর লক্ষণ হতে পারে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর, প্রচণ্ড মাথাব্যাথা, চোখের পেছনে ব্যথা, পেশিতে ব্যথা, বমি বমি ভাব, বমি, ফোলা গ্রন্থি এবং র্যাশ।
তবে জ্বর চলে যাওয়ার পরও মারাত্মক ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিতে পারে। আর মারাত্মক ডেঙ্গু হলে পেটে প্রচণ্ড ব্যথা, অব্যাহত বমি, দ্রুত নিশ্বাস, নাগ দিয়ে রক্ত পড়া, ক্লান্তি, অস্বস্তি, বমিতে রক্ত, প্রচণ্ড তৃষ্ণা, শরীর ফ্যাকাসে ও ঠান্ডা হয়ে যাওয়া এবং প্রচণ্ড দুর্বলতা অনুভব হবে।
এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত সময়ের মধ্যে চিকিৎসা নিতে হবে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
মশার কামড়ে ছড়ায় ডেঙ্গু
ডেঙ্গু একটি ভাইরাস জনিত সংক্রমণ রোগ, এটি মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। এই ডেঙ্গু গ্রীষ্মমন্ডলীয় এলাকাগুলোতে অনেকবার তাণ্ডব চালিয়েছে। এটি ছড়ানোর জন্য এডিস ইজিপ্টি এবং এডিস অ্যালবোপিকটাস মশা দায়ী। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত একটি মশা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন এটি সংক্রমণ ছড়িয়ে যেতে পারে।
বর্তমানে ডেঙ্গুর কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেওয়া হলে মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, চিকিৎসার মূল লক্ষ্য থাকে শরীরের ব্যথা কমানো। আর ব্যথা কমাতে প্যারাসিটামল ব্যবহার করা হয়। তবে নন-স্ট্রয়োডিয়াল এবং প্রদাহ বিরোধী ওষুধ যেমন ইবুপ্রোফেন এবং এসপিরিনের ব্যবহার এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ এসব ওষুধের কারণে রক্তপাত হতে পারে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ ও মূল্যায়ন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের মূল্যায়নে বলেছে বাংলাদেশ ডেঙ্গুর ‘উচ্চ’ ঝুঁকিতে রয়েছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেশি এবং ব্যাপক ভৌগলিক বিস্তৃতির কারণেই সংস্থাটি এমন মূল্যায়ন দিয়েছে।
মশার বিস্তৃতি রোধে ডব্লিউএইচও সমন্বিত ভেক্টর ব্যবস্থাপনা (আইভিএম) গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। এছাড়া মানুষকে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছে তারা। যার মধ্যে রয়েছে মশার প্রজনন সহায়ক স্থানগুলো ধ্বংস করা।
এছাড়া সতর্কতা হিসেবে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও ঘরের পানি জমিয়ে রাখার পাত্র বা ট্যাংক পরিষ্কার ও ঢেকে রাখা, মশারি ব্যবহার ও স্প্রে ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
অপরদিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সতর্কতার অংশ হিসেবে ফুলহাতা শার্ট-প্যান্ট পরা, মশার কয়েল ও স্প্রে ব্যবহার, দরজা-জানালায় মশা প্রতিরোধী জাল ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বুইউ