ঢাকাঃ কুরবানি ঈদের পর এবং বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের পর কিছু মানুষ সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যতায় ভোগেন এবং এই নিয়ে চিকিৎসকদের পরামর্শ চেয়ে থাকেন। আজ চেষ্টা করবো এ বিষয়ে করনীয় কিছু বিস্তারিত আলোচনা।
কোষ্ঠকাঠিন্যঃ
কোষ্ঠকাঠিন্য শব্দটি একেকজনের কাছে একেক রকম অর্থবহন করে। কোষ্ঠকাঠিন্য হচ্ছে খুব শক্ত মলত্যাগ হওয়া, কিংবা সপ্তাহে তিনবারের কম মলত্যাগ হওয়া কিংবা মলত্যাগ করতে প্রচুর সময় ব্যয় হওয়া, খুব জোরাজুরি কিংবা বল প্রয়োগ করে কিংবা মলদ্বারে কোন কিছু প্রবেশ করিয়ে মলাশয় খালি করা বা মলত্যাগ করার পর মনে হওয়া যে, মলাশয় খালি হয়নি এরকম। কোষ্ঠকাঠিন্য দুই ধরনের-
১। Acute Constipation বা সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্য
২। Chronice Constipation বা দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য
সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যঃ
যদি অল্প কয়েক দিনের জন্য কোষ্ঠকাঠিন্যতার উপসর্গ দেখা দেয়, অথবা কোষ্ঠকাঠিন্যতার সময় যদি তিন মাসের কম হয়, তাহলে এই অবস্থাকে সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যতা বলে।
উদাহরণস্বরুপ, কোথাও কোনো অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রচুর পরিমান গোস্ত খাওয়ার পর দেখা গেলো দুই-তিন দিন মলত্যাগ হচ্ছেনা কিংবা খুব শক্ত অল্প অল্প মলত্যাগ হচ্ছে, তাহলে এই অবস্থাকে Acute constipation বা সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্য বলে।
অথবা দেখা গেলো, প্রতিদিন তিন বেলায় গোস্ত, মাছ, ডিম ইত্যাদি দিয়ে ভাত খাচ্ছে, তাই নিয়মিত মলত্যাগ হচ্ছে না, হলেও শক্ত মলত্যাগ হচ্ছে কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্যতা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, তা যদি তিন মাসের কম সময় হয়ে থাকে, তাহলে একে সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্য বলা হবে। অথবা সারা বছর সুস্থ, কিন্তু কুরবানি ঈদের দিন, ঈদের পরে প্রচুর পরিমান গোস্ত খাওয়ার পর দেখা গেলো মলত্যাগ হচ্ছেনা, পেট ফুলে যাচ্ছে, পেটে ব্যথা হচ্ছে, তবে এই অবস্থাকেও Acute Constipation বা সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্য বলা হয়।
সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যতার উপসর্গঃ
সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যতার ফলে যেসব জটিলতা দেখা দিতে পারে তা হলো-
* হেমোরয়েড বা পাইলস: পায়ুপথের আশেপাশের রক্তনালী সমূহে প্রদাহ হতে পারে এবং মলত্যাগ করার সময় পায়ুপথে রক্ত যেতে পারে, এমনকি ব্যথাও হতে পারে, পায়ু পথে চুলকানি দেখা দিতে পারে।
* এনাল ফিস্টুলা দেখা দিতে পারে।
* ইউরিনারি ইনকন্টিনেন্স/প্রসাবে অনিয়ম দেখা দিতে পারে।
সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যতার কারণঃ
Acute constipation বা সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যতা মূলত অস্বাভাবিক লাইফ স্টাইলের কারণে দেখা দেয়। যেমন-
মেডিসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যথা- ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার, এন্টি স্পাজমোডিক, এন্টি ডায়েরিয়াল ড্রাগস, আয়রন ট্যাবলেট, অ্যালুমিনিয়াম যুক্ত এন্টাসিড ইত্যাদি।
দৈনিক অত্যাধিক পরিমান প্রোটিন খাওয়া যেমন অধিক পরিমান গোস্ত খেলে সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্যতা দেখা দিতে পারে।
দৈনিক প্রোটিনের পরিমান কতটুকু হওয়া চাই?
ইনস্টিটিউট অব মেডিসিন ইউএসএ'র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক প্রোটিন চাহিদা হচ্ছে ১ গ্রাম/কেজি বডি ওয়েট। অর্থাৎ একজন মানুষের ওজন যদি ৬০ কেজি হয়ে থাকে, আর সে যদি ভারি কোনো কাজ না করে, তাহলে তার দৈনিক প্রোটিন দরকার পড়ে ৬০ গ্রাম। আর ভারি কাজ করলে আরো ৩০ গ্রাম বাড়বে, অর্থাৎ ৯০ গ্রাম প্রোটিন দরকার। এটা হচ্ছে স্বাভাবিক শারিরীক ক্রিয়া প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন।
তবে একজন সুস্থ মানুষ কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ব্যতীত দৈনিক সর্বোচ্চ ২ গ্রাম/কেজি বডি ওয়েট করে প্রোটিন খেতে পারবে। সুতরাং একজন ৬০ কেজি ওজনের মানুষ দৈনিক সর্বোচ্চ ১২০ গ্রাম প্রোটিন খেতে পারবে কোনো পার্শপ্রতিক্রিয়া ব্যতীত। এর চেয়ে বেশি খেলে ডায়রিয়া কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে। প্রোটিনের উপাদান হচ্ছে গোস্ত, মাছ, ডিম ইত্যাদি।
এবার বুঝে নিই, ১২০ গ্রাম প্রোটিন খেতে পারলে কত গ্রাম গোস্ত খাওয়া যাবে?
আমরা অনেকে মনে করে থাকি যে, এক গ্রাম গোস্ত মানে এক গ্রাম প্রোটিন, যা ভুল ধারণা। আমেরিকার ইন্সটিটিউট অব মেডিসিনের তথ্য অনুযায়ী, ১০০ গ্রাম রান্না করা গোস্তের মাঝে ২৬ গ্রাম প্রোটিন, ১০ গ্রাম ফ্যাট, ৬১-৬৩ গ্রাম পানি থাকে। তার মানে, গোস্ত থেকে ২৬ গ্রাম প্রোটিন পেতে হলে ১০০ গ্রাম গোস্তের প্রয়োজন, তথা ১ গ্রাম প্রোটিনের জন্য প্রায় ৪ গ্রাম গোস্তের দরকার। আমরা একটু আগে জেনেছি, একজন ৬০ কেজি ওজনের সুস্থ লাইট ওয়ার্কার মানুষের দৈনিক প্রোটিন চাহিদা হচ্ছে ৬০ গ্রাম, সুতরাং সে স্বাভাবিক গোস্ত থেকে সেই পরিমান প্রোটিন নিতে চাইলে ৬০x৪=২৪০ গ্রাম গোস্ত খেলেই যথেষ্ট।
আবার ৬০ কেজি ওজনের মানুষ দৈনিক সর্বোচ্চ ১২০ গ্রাম প্রোটিন কিংবা ৪৮০ গ্রাম গোস্ত খেতে পারবে। তবে তা হতে হবে তিন বেলায় ভাগ করে অল্প অল্প করে। অন্যথায় Malabsorption syndrome কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিবে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে ২০০ গ্রামের বেশি গোস্ত খেলেও কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে।
সাময়িক কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে করণীয়ঃ
লাইফস্টাইল পরিবর্তন করার মাধ্যমে কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করা যায়। যেমন-
সম্ভব হলে প্রতিদিন আপেল খাওয়া উত্তম, আপেলে পর্যাপ্ত ফাইবার রয়েছে নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে এবং পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে।
অবশ্যই যেটা খেয়াল রাখবেন
যেদিন বেশি পরিমানে গোস্ত খাওয়া হবে, সেদিন গোস্তের সাথে শাক সবজি, গাজর, শসা ইত্যাদি খেতে হবে। এবং সকাল, দুপুর, রাত্রে এক গ্লাস পানিতে দুই টেবিল চামচ ইসবগুলের ভূসি মিশিয়ে ইসবগুলের শরবত খেতে পারেন। এতে করে কোলনের মধ্যে কিছু পরিমান পানি রিটেনশন হবে এবং মল তরল থাকবে, কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। যারা নিয়মিত ইসবগুলের শরবত খায়, তাদের কোষ্ঠকাঠিন্যতার প্রবণতা ৯০% কমে যায়।
ঈদ উৎসবে পরিমিত এবং সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন। হঠাৎ করে অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। এতে দেহ ও মন সুস্থ থাকবে। সবার উৎসব আনন্দময় হোক।
পরামর্শ দিয়েছেন:
ডা. ইসমাইল আজহারি
পরিচালক, সেন্টার ফর ক্লিনিক্যাল এক্সিলেন্স এন্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ।
এমবুইউ