দেশে গত চার মাসে করোনা পরীক্ষায় ৪০ শতাংশ ল্যাব বেড়েছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) মাত্র একটি ল্যাবরেটরি থেকে এখন এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭১-এ। কিন্তু ল্যাবরেটরির সংখ্যা অনুপাতে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়েনি। সবচেয়ে কম সক্ষমতার হিসাবে ধরলেও এখনো এসব ল্যাবের ৩৫ শতাংশ সক্ষমতাই কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অথচ এসব ল্যাবে বর্তমান লোকবল দিয়েই কমপক্ষে প্রতিদিন ২৭ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব।
বিশেষজ্ঞরাও দেশে করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ঠেকাতে এবং রোগটি নিয়ন্ত্রণে নমুনা পরীক্ষা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে আসছেন। তারা বলছেন, পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত যত বেশি হবে, তত বেশি রোগীদের আটকানো যাবে ও তাদের থেকে আর নতুন করে কেউ সংক্রমণ হবে না। সেটা না হলে পরীক্ষার বাইরে থাকা সংক্রমিত ব্যক্তি ও তাদের সংস্পর্শে আসা লোকজনের থেকে রোগটি আরও বেশি করে ছড়াবে।
বিশেষজ্ঞরা এমনও বলেছেন, সংক্রমণের গতি অনুযায়ী বর্তমানে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা উচিত। করোনা মোকাবিলায় গঠিত সরকারের জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির হিসাবে অন্ততপক্ষে ২০ হাজার করতেই হবে।
অথচ দেশে নমুনা পরীক্ষা কিছুতেই বাড়ছে না। গত কয়েক দিন ধরে প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে না। উল্টো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বেশকিছু সিদ্ধান্তে নমুনা পরীক্ষা আরও কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে সরকারিভাবে পরীক্ষার জন্য ফি নির্ধারণের কারণে ইতিমধ্যেই নমুনা সংগ্রহ কমতে শুরু করেছে। কিটের সংকটের কারণে বুথগুলোকে নমুনা সংগ্রহ কমাতে বলা হয়েছে। সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানে নমুনা নেওয়া হয়, সেখানেও কম করে নমুনা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া করোনা পজিটিভ রোগীদের নেগেটিভ রিপোর্ট জানতে দ্বিতীয় পরীক্ষা করা হচ্ছে না।
এসব প্রেক্ষাপটে আইইডিসিআরের পরামর্শক ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশে পরীক্ষার সংখ্যা বেড়েছে। আবার আক্রান্তের সংখ্যা তার চেয়েও বেশি বেড়েছে। তার মানে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। তাই যত বেশি পরীক্ষা হবে তত সুবিধা হবে।
একইভাবে ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. একেএম শামসুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, অবশ্যই পরীক্ষা বাড়ানো উচিত। এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা। টেস্ট বাড়াতে হবে। শনাক্ত সংখ্যা বাড়াতে হবে। যত বেশি শনাক্ত হবে তাদের আইসোলেশন করে দিতে হবে; যাতে পুনরায় সংক্রমণ বাড়তে না পারে। তারপরও আমি বলব, আমাদের পরীক্ষা বাড়ানো প্রয়োজন। তবে নমুনা সংগ্রহ বাড়ানোর পাশাপাশি নমুনা পরীক্ষার যেসব সুযোগ-সুবিধা, সেটাও আমাদের দেশে সংগতিপূর্ণভাবে বাড়ানো প্রয়োজন।
গত ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের পর সীমিত আকারে পরীক্ষা শুরু হয়। তখন মূলত বিদেশফেরত ব্যক্তি এবং তাদের সংস্পর্শে আসা যেসব ব্যক্তির উপসর্গ দেখা দিত তাদেরই পরীক্ষা করত আইইডিসিআর। কিন্তু ধীরে ধীরে সংক্রমণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এ অবস্থায় এপ্রিলের মাঝামাঝিতে নমুনা পরীক্ষাকেন্দ্র, পরীক্ষার সংখ্যা ও পরিধিও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এখন বিভিন্ন জায়গায় ৭১ পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। কিন্তু ল্যাব ও সংক্রমণ অনুপাতে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়েনি।
সংক্রমণের ধারা বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একজন রোগী শনাক্ত করতে যদি ১০ থেকে ৩০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা যায়, তাহলে পরীক্ষা পর্যাপ্ত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত একজন রোগী শনাক্তে ৫ দশমিক ২৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। অথচ গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে নমুনা সংগ্রহের সংখ্যা কমানো হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও বুথে করোনা পরীক্ষার জন্য অসংখ্য রোগী ভিড় করলেও গত কয়েক দিন ধরে সবার নমুনা নেওয়া হচ্ছে না। নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার সঙ্গে জড়িতরা জানিয়েছেন, এখন নমুনা সংগ্রহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর একেবারে প্রয়োজন ছাড়া, উপসর্গহীন ব্যক্তিদের পরীক্ষা করা হচ্ছে না। আগে যেসব প্রতিষ্ঠানে ৩০০-এর মতো নমুনা সংগ্রহ করা হতো এখন তা ১৫০ কিংবা ১৮০-তে এসে নেমেছে।
এছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত ৫৪টি বুথে নমুনা সংগ্রহ হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ১০১টি বুথ স্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু কিট সংকটের কারণে বাকি বুথগুলো তারা স্থাপন করতে পারছে না। ব্র্যাকের বুথের রিপোর্ট সংগ্রহ করেন, এমন একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কিছু বুথে নমুনা সংগ্রহের পরিমাণ আগের চেয়ে কমেছে। আগে প্রতি বুথে ৩০টি করে নমুনা সংগ্রহ করা হতো। এখন তা কমে হয়েছে ১৫ থেকে ২০টি। আবার কিছু বুথে আগের মতোই নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, গত তিন মাসে আট লাখের মতো টেস্টিং কিট আমদানি করা হয়েছে। তবে কিটের মজুদ খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যাচ্ছে। সে কারণেই কয়েকটি ল্যাবে কিটের সরবরাহ বন্ধ আছে। আর ল্যাবগুলোতে পরীক্ষার সংখ্যা কমিয়ে দিতে বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ সমস্যা সমাধানে একটি মানসম্মত কর্মপদ্ধতি তৈরি করতে এবং কিটের মজুদ বাড়াতে কাজ করছে। অবশ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা জানান, কিটের কোনো অভাব নেই এবং পরীক্ষাগারগুলোতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক কিট সরবরাহ করা হচ্ছে।
এদিকে সরকারিভাবে করোনা পরীক্ষায় ২০০ টাকা ফি নির্ধারণের কারণে গত দুদিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে নমুনার পরিমাণ কমে গেছে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও নারায়ণগঞ্জে আগের তুলনায় ২৫-৩০ শতাংশ নমুনা কম সংগ্রহ হচ্ছে। এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিসেস (বিআইটিআইডি) ল্যাবের প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ডা. শাকিল আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, আগে যেখানে ৫০০-৫৫০ নমুনা ছিল, সেটা এখন ৩৫০-৪০০-এর মধ্যে চলে এসেছে। সবখানেই সার্বিকভাবে কমেছে। একইভাবে নারায়ণগঞ্জেও নমুনা আসা কমেছে বলে জানা গেছে। জেলা সিভিল সার্জনের এক কর্মকর্তা জানান, ১ জুলাই থেকে ফি নিয়ে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ২২৪ জনের নমুনা সংগ্রহ হয়েছে। কিন্তু ৩০ জুন নমুনা এসেছিল ৪১৮টি। আর ১ জুলাই নমুনা আসে ৩৬৩টি। অর্থাৎ গত দুদিন ধরে নমুনা কমছে।
অন্যদিকে গত চার মাসে করোনা পরীক্ষায় ল্যাবরেটরির সংখ্যা বাড়লেও সে অনুপাতে পরীক্ষা বাড়েনি। ল্যাবগুলোর সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে ল্যাবের টেকনোলজিস্টরা বলছেন, কিট ও লোকবল সংকটের কারণে এতদিন নমুনা জমে থাকত। সব পরীক্ষা করা যেত না। গত দুই-তিন সপ্তাহ ধরে নমুনাই কম আসছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মার্চে আইইডিসিআরের একটি ল্যাবে পরীক্ষা করা হতো। তখন এক দিনে সর্বোচ্চ ৯২টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। পরে ৩ এপ্রিল ল্যাবের সংখ্যা ১০টি হয়। এসব ল্যাবে সর্বোচ্চ ২০৩টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। ২১ এপ্রিল ল্যাব ২১টি হয় এবং সর্বোচ্চ পরীক্ষা হয়েছিল ৩ হাজার ৮১২টি। ১ মে ল্যাব হয় ৩১টি ও এসব ল্যাবে সর্বোচ্চ পরীক্ষার সংখ্যা ৫ হাজার ৮২৭টি। মে মাসের মাঝামাঝিতে ল্যাব বেড়ে দাঁড়ায় ৪১-এ ও সর্বোচ্চ পরীক্ষা হয় ৬ হাজার ৭৮২টি। ল্যাবের সংখ্যা অর্ধশতে পৌঁছায় ২৯ মে। এ ৫০ ল্যাবে এক দিনে সর্বোচ্চ পরীক্ষা হয়েছিল ৯ হাজার ৯৮৭টি। গত ১৪ জুন সে ল্যাব বেড়ে হয় ৬০টি ও সর্বোচ্চ পরীক্ষা হয় ১৫ হাজার ৩৮টি। গত ২ জুলাই ল্যাবের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০-এ এবং সেদিন পরীক্ষা হয়েছিল ১৮ হাজার ৩৬২টি। কিন্তু গতকাল শুক্রবার সে পরীক্ষা নেমে আসে ১৪ হাজার ৬৫০-এ। ৭১টি ল্যাবের মধ্যে গতকাল আটটি ল্যাবে কোনো পরীক্ষা হয়নি।
ল্যাবসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনো দেশের ৭১টি ল্যাবের খুব কম করে হলেও দিনে ২৭ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব। এসব ল্যাবে কর্মরত বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশের ৭১টি ল্যাবের মধ্যে অন্তত সাতটি ল্যাবে দুটি করে পিসিআর মেশিন আছে। বাকি ৬৪ ল্যাবে একটি করে পিসিআর মেশিন। আর ঢাকার ন্যাশনাল রেফারেন্স ল্যাবে চারটি পিসিআর মেশিন আছে। প্রত্যেকটি মেশিন দিয়ে দুই শিফটে কমপক্ষে ৩০০টি নমুনা পরীক্ষা করা যায়। এজন্য নতুন লোকবলও দরকার হবে না। আর যদি আরও বেশি পরীক্ষা করাতে চায় তাহলে লোকবল বাড়াতে হবে। তারা বলেন, এসব ল্যাবের ৩৫ শতাংশ সক্ষমতা ব্যবহার হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে বিআইটিআইডি ল্যাবের প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ডা. শাকিল আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রতিদিন ৫০ হাজার নমুনা পরীক্ষা হওয়া উচিত। তবে আমাদের এই মুহূর্তে সক্ষমতা নেই। প্রস্তুতি দুর্বল। কিন্তু অন্তত ৩০ হাজার করতে পারি। এ পরীক্ষার সক্ষমতা আমাদের আছে।
অন্যদিকে এখনো দেশের ৪৪ জেলায় পরীক্ষার জন্য কোনো ল্যাবরেটরি নেই। ৭১টি ল্যাবের ৩৭টি ঢাকায়। বাকি ৩৪টি ঢাকার বাইরে ১৯টি জেলায়, যার মধ্যে চট্টগ্রামে রয়েছে ছয়টি। এছাড়া নোয়াখালী, রাজশাহী, বগুড়া, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে দুটি করে ল্যাব রয়েছে। বাকি ৪৪ জেলার কোনোটিতেই এখনো ল্যাবরেটরি চালু হয়নি করোনা পরীক্ষার জন্য। (খবর : দৈনিক দেশ রূপান্তর, ০৭ জুলাই ২০২০)