গোটা বিশ্বকেই অভূতপূর্ব এক দুর্যোগের মুখে ঠেলে দিয়েছে নভেল করোনাভাইরাস। বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নিয়েছে ভাইরাসটির সংক্রমণজনিত রোগ কভিড-১৯। শুধু স্বাস্থ্য খাত নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও মহাবিপদের ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে নভেল করোনাভাইরাস। থমকে দাঁড়িয়েছে বৈশ্বিক উৎপাদন ও সেবা খাত। নানা প্রণোদনা দিয়েও এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে কোনো আশার আলো দেখাতে পারেনি সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। এরই মধ্যে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে গেছে বৈশ্বিক পর্যটন খাত। এয়ারলাইনসগুলোও এখন দেউলিয়াত্বের শঙ্কায়। সামনের দিনগুলোয় এ পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর দিকে মোড় নিতে পারে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের।
চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। বিশ্বব্যাপী সর্বশেষ বড় আকারের মন্দা দেখা গিয়েছিল ২০০৮ সালে। ওই সময়কার বাজার পারিপার্শ্বিকতার বেশকিছু উপাদান চলতি বছরের শুরুতেও পরিলক্ষিত হচ্ছিল।
বছরের শুরুতেই মার্কিন প্রতিষ্ঠান জিওপলিটিকাল ফিউচার্স জানিয়েছিল, বিশ্ব অর্থনীতিতে আরেকটি শ্লথতার বছর আসছে। ২০০৮ সালের সংকটকালীন পরিস্থিতিতে যেসব বাজারে যেসব বিষয়ের উপস্থিতি দেখা গিয়েছিল, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এবারো সেগুলোর উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। ফলে চলতি বছর বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কিছুটা শ্লথতা দেখা যেতে পারে।
২০০৮ সালের সংকটটি ছিল মূলত রফতানিকারকদের সংকট। সে সময় রফতানিনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো, বিশেষত চীন বিশ্বব্যাপী তৈরি পণ্যের চাহিদা পতনের ধারাবাহিকতায় বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাশিয়া ও সৌদি আরবের মতো কাঁচামাল রফতানিকারকরা। ২০২০ সাল নিয়ে ধারণা ছিল, এবারো একই পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। তবে বিজনেস সাইকেলের নিয়মিত আবর্তনেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু সে সময় নভেল করোনাভাইরাসের আবির্ভাবের বিষয়টি মাথায় ছিল না কারোরই। ফলে বছরের শুরুতে বৈশ্বিক অর্থনীতি নিয়ে যতগুলো পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে, তার কোনোটিতেই কভিড-১৯-এর আবির্ভাব এবং এর ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
ব্লুমবাগের সম্প্রতি প্রকাশিত এক পূর্বাভাসে বলা হয়, কভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী চলতি বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দাঁড়াতে পারে মাত্র দশমিক ১ শতাংশে।
পূর্বাভাসে চার ধরনের সম্ভাব্য পরিস্থিতির ক্ষেত্রে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি কেমন হতে পারে, তার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুধু চীনে সীমাবদ্ধ থাকলেও এর হার দাঁড়াত ২ দশমিক ৯ শতাংশে। আরো কিছু দেশ আক্রান্ত হলে সম্ভাব্য বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ। ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে এটি দাঁড়াতে পারে ১ দশমিক ২ শতাংশে। আর কভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নিলে তা হবে দশমিক ১ শতাংশ।
উল্লেখ্য, কভিড-১৯-কে এরই মধ্যে বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। অন্যদিকে পরিস্থিতি খুব বেশি দীর্ঘায়িত হলে কী হবে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা দেয়া হয়নি ব্লুমবার্গের পূর্বাভাসেও।
বিশ্ব অর্থনীতি এরই মধ্যে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ধসের ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না আর্থিক, মুদ্রা ও পণ্যবাজার। করোনার অর্থনৈতিক আঘাতের তীব্রতা কমাতে বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে সুদহার নামিয়ে এনেছে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। তার পরও দেশটিতে ঋণপ্রবাহের পতন (ক্রেডিট ক্রাঞ্চ) ও আর্থিক বাজারের ধস কতটুকু ঠেকানো সম্ভব, সে বিষয়ে সন্দিহান সবাই। দেশটিতে একের পর এক কারখানা এখন বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ফেডারেল কর্মীরা ছাড়া দেশটির অন্য সবাই এখন অফিস করছেন ঘরে বসে। অর্থাৎ, উৎপাদনের পাশাপাশি ধস নামছে দেশটির সেবা খাতেও।
বছরের প্রথম দুই মাসে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের অর্থনীতির পতন হয়েছে নাটকীয়ভাবে। এ দুই মাসে দেশটিতে শিল্পোৎপাদন কমেছে সাড়ে ১৩ শতাংশ। অথচ ধারণা করা হচ্ছিল, এ পতনের হার দাঁড়াতে পারে মাত্র ৩ শতাংশে।
উৎপাদনের পাশাপাশি ভোগের ক্ষেত্রেও চীনের পরিসংখ্যান নিম্নমুখী। এ সময়ে দেশটিতে খুচরা পর্যায়ের বিক্রি কমেছে সাড়ে ২০ শতাংশ। অন্যদিকে বিভিন্ন পূর্বাভাসে এ পতনের হার ৪ শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে বলে এতদিন সান্ত্বনা দিয়ে এসেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ সময় দেশটির অবকাঠামো, সম্পদ, যন্ত্রপাতি ইত্যাদিতে অর্থাৎ স্থায়ী সম্পদে বিনিয়োগও হ্রাস পেয়েছে সাড়ে ২৪ শতাংশ। দেশটির সরকার মাসিক ভিত্তিতে অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান প্রকাশ শুরুর পর থেকে শিল্পোৎপাদন, ভোগ ও স্থায়ী সম্পদে বিনিয়োগের ধারায় নিম্নমুখিতা দেখা যায়নি কখনোই। এমনকি অতীতের অর্থনৈতিক দুর্বিপাকের বছরগুলোয়ও না।
তবে চলতি মাসেই কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে চীন। কলকারখানাগুলোও খুলতে শুরু করেছে। নভেল করোনাভাইরাসের ধাক্কা মোকাবেলা করা ও সেখান থেকে আসার প্রত্যয় ও সামর্থ্য—দুটোই রয়েছে দেশটির। তার পরও অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাকোয়ার গ্রুপ বলছে, চলতি প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) চীনের অর্থনীতি সংকুচিত হতে পারে ৬ শতাংশ।
নভেল করোনাভাইরাসের আঘাতের প্রাথমিক ও সবচেয়ে বড় ধাক্কা সহ্য করা দেশটির বাইরে সুখবর শোনাতে পারছে না আর কেউই। ইউরোপ মহাদেশের সেবা খাত পুরোপুরি ধসে পড়েছে। এতদিন পর্যন্ত আর্থিক শ্লথতা ও উৎপাদনে ধসের মতো ধাক্কা সামলানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে মহাদেশটির সেবা খাতের সমৃদ্ধি। প্রকৃতপক্ষে এতদিন ইউরোপীয় অর্থনীতির শেষ প্রতিরক্ষা লাইনের দায়িত্ব পালন করেছে সেবা খাত। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে পড়া থেকে শুরু করে দেশের পর দেশ লকডাউনে চলে যাওয়ার কারণে সেবা খাতও ইউরোপের বিপর্যয় ঠেকানোর সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। মহামন্দা ইউরোপে অবশ্যম্ভাবী। এ বিষয়ে একমত অর্থনীতিবিদদের সবাই।
ইউরোপে করোনার সবচেয়ে মারাত্মক আঘাত পড়েছে ইতালির ওপর। এখন তা সংক্রমিত হয়েছে মহাদেশটির বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলোয়ও। ফ্রান্স এরই মধ্যে জনগণকে টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্যগুলো ছাড়া আর সব ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। স্পেন এরই মধ্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে দিয়েছে। জার্মানি এখন পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে লকডাউনের ঘোষণা দেয়নি। তবে সীমান্ত আংশিক বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া দেশটির রাজধানী বার্লিনেও এখন বেশকিছু কঠোর নিয়মকানুনের প্রয়োগ করা হচ্ছে।
ইউরোপীয় সেবা খাতে সবচেয়ে বড় আয়ের অন্যতম উৎস পর্যটনও পুরোপুরি ধসে পড়েছে। মহাদেশটির ২৪টি দেশ পর্যটকদের আগমন বন্ধ করে দিয়েছে। অবশ্য শুধু ইউরোপ নয়, বৈশ্বিক পর্যটন খাতের গোটাটাই এখন ধসে পড়েছে।
আয়ারল্যান্ডের অর্থনীতিতে কোটি কোটি ইউরো যোগ হয় দেশটির বড় উৎসব সেন্ট প্যাট্রিকস ডেতে। করোনার কারণে এটিও বাতিলে বাধ্য হয়েছে দেশটির সরকার।
পর্যটন খাতের ধস সংক্রমিত হয়েছে এয়ারলাইনস খাতে। এয়ারবিএনবি থেকে শুরু করে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ পর্যন্ত ছোট-বড় সব এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠানের একের পর এক ফ্লাইট বাতিল হচ্ছে। ফেরত দিতে হচ্ছে যাত্রীদের অর্থ। ডয়েচে লুফতহানসা জার্মানির রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কাছে ঋণের আবেদন করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গেলে জার্মান সরকার এয়ারলাইনসটির শেয়ার কিনে নেয়া ছাড়া লুফতহানসাকে বাঁচানো বেশ মুশকিল হয়ে পড়বে।
ইউরোপের দেশগুলোর সরকার এরই মধ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পরিবারগুলোর পেছনে কয়েকশ কোটি ইউরো ব্যয় করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। তার পরও মহাদেশটির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ কাটানোর কোনো উপায়ই দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা। ইউরোপীয় কমিশনও (ইসি) ইউরোপের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি নয়, সংকোচনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। রাষ্ট্রীয় ও ইইউ পর্যায়ে গৃহীত প্রণোদনামূলক নানা সমন্বিত পদক্ষেপও এ বিপদ ঠেকানোয় যথেষ্ট নয়।
চীন ছাড়া অন্যান্য দেশের অর্থনীতিও এখন করোনার প্রভাবে বিপর্যস্ত। এশিয়ার বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে প্রতিবেশী ভারত নানা কারণে এরই মধ্যে বাজে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। সে পরিস্থিতিকে আরো মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে কভিড-১৯। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) গভর্নর শক্তিকান্ত দাসও গতকাল এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এর কারণ হিসেবে শক্তিকান্ত দাস বলছেন, দেশটির পর্যটন, এয়ারলাইনসসহ সার্বিক সেবা খাতই এখন করোনার কারণে বিপর্যয়ের মুখে। পাশাপাশি দেশটির বৈদেশিক বাণিজ্যের অবস্থাও খুব একটা সুবিধার না। (খবর : দৈনিক বণিক বার্তা, ১৭ মার্চ, ২০২০)