পুঁজিবাজার থেকে ২৮ হাজার কোটি টাকার মূলধন নিয়েছে ব্যাংকগুলো

নিউজ ডেস্ক মার্চ ১৬, ২০২০, ০৮:৫৪ এএম

দেশে বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৩০টি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির আগে এ ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত পরিশোধিত মূলধন ছিল ১ হাজার ৫৫৩ কোটি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মোট পরিশোধিত মূলধন দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ পুঁজিবাজার থেকে ২৮ হাজার কোটি টাকার বেশি মূলধন সংগ্রহ করেছে ব্যাংকগুলো।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসার আগে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৮ কোটি টাকা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসে তা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ইসলামী ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৭৪১ কোটি টাকা, যেটি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬১০ কোটি টাকায়। ২০১০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আইএফআইসি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ছিল ২১৮ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে এসে এটি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকায়।

আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসার আগে এক্সিম ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৭২ কোটি ১৯ লাখ টাকা, যেটি সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে এসে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসার আগে ব্র্যাক ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ছিল ১০০ কোটি টাকা। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে এটি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৩৩ কোটি টাকায়। ব্যাংক এশিয়া আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসার আগে তাদের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৬০ কোটি টাকা, যা ফেব্রুয়ারি শেষে ১ হাজার ১৬৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসার আগে সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৩০ কোটি টাকা, যা সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে এসে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন আইপিওর আগে ছিল ৮ কোটি টাকা, যা এ বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে ১ হাজার ১৬০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। প্রাইম ব্যাংক আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসার আগে পরিশোধিত মূলধন ছিল ৪০ কোটি টাকা, যেটি সর্বশেষ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৩২ কোটি টাকায়।

আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসার আগে পরিশোধিত মূলধন ছিল ২৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ফেব্রুয়ারি শেষে এটি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৫ কোটি টাকায়। আইপিওতে আসার আগে পূবালী ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৮ কোটি টাকা। আর এ বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ১ হাজার ২৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। দ্য সিটি ব্যাংক আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসার আগে তাদের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৮ কোটি টাকা, যেটি সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে এসে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৬ কোটি টাকা।

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের আইপিওর আগে পরিশোধিত মূলধন ছিল ৬৬ কোটি, যা সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি শেষে ৯৫৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আইপিওতে আসার আগে

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৬৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। সর্বশেষ এ বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ছিল ৯৩৭ কোটি টাকা। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের আইপিওতে আসার আগে পরিশোধিত মূলধন ছিল ১৮৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা, যা এ বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে ৯৩৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আইপিওতে আসার আগে এনসিসি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৩৯ কোটি টাকা। আর এ বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন দাঁড়িয়েছে ৯২৭ কোটি টাকায়।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন আইপিওতে আসার আগে ছিল ১৬৯ কোটি টাকা, যা এ বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে ৯২৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

আইপিওতে আসার আগে এসআইবিএলের পরিশোধিত মূলধন ছিল ২৬ কোটি টাকা। আর এ বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ৮৯৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন আইপিওর আগে ছিল ২৩০ কোটি টাকা, যা এ বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে ৮৬৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ঢাকা ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন আইপিওতে আসার আগে ছিল ২৬ কোটি টাকা। আর এ বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন দাঁড়িয়েছে ৮৫৩ কোটি টাকায়। আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসার আগে ওয়ান ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৬০ কোটি টাকা, যা এ বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে ৮৪৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

ইস্টার্ন ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ২০১০ সালে ছিল ২৯২ কোটি টাকা, যা সর্বশেষ এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসে ৮১২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসার আগে এবি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ছিল ১০ কোটি টাকা, যা এ বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে ৭৫৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। যমুনা ব্যাংকের আইপিওতে আসার আগে পরিশোধিত মূলধন ছিল ৮৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আর এ বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ছিল ৭৪৯ কোটি টাকা। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন আইপিওতে আসার আগে ছিল ৪০ কোটি টাকা, যা এ বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে ৭০৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে আসার আগে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ছিল ১৫ কোটি টাকা, যা এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসে ৬৬৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ট্রাস্ট ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন আইপিওতে আসার আগে ছিল ১১৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, যা এ বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে দাঁড়িয়েছে ৬১৩ কোটি টাকায়।

আইপিওতে আসার আগে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ছিল ২১ কোটি ৩২ লাখ টাকা, যা এ বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে ৫০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। রূপালী ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন আইপিওতে আসার আগে ছিল ২৮ কোটি টাকা। আর এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন দাঁঁড়িয়েছে ৪১৪ কোটি টাকায়। উত্তরা ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন আইপিওতে আসার আগে ছিল ১০ কোটি টাকা, যা এ বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে ৪০৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

তালিকাভুক্তির পরে বিভিন্ন সময়ে রাইট শেয়ার ও বোনাস শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে এ মূলধন বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। নিজেদের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় বাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করলেও শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সরকারের উদ্যোগে সাড়া দিচ্ছে না তালিকাভুক্ত এসব ব্যাংক।

চলতি বছরের শুরু থেকেই পুঁজিবাজারে টানা দরপতন ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়। এর মধ্যে ব্যাংকের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়ানো ছিল অন্যতম। চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি সার্কুলার জারি করা হয়। এর মাধ্যমে তফসিলি ব্যাংকগুলোর প্রতিটিকে সর্বোচ্চ ২০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেয়া হয়। তহবিল গঠনের বিষয়টি ঐচ্ছিক হলেও বাজারসংশ্লিষ্টদের মধ্যে ধারণা ছিল, সবগুলো ব্যাংকই হয়তো পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতার জন্য বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। বিশেষ তহবিল গঠনসংক্রান্ত সার্কুলার জারির পর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল বাজারে। বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ায় সে সময় ডিএসইর লেনদেন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার জারির পরে এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ১২টি ব্যাংক তহবিল গঠনের আবেদন জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। অথচ দেশে তফসিলি ব্যাংক রয়েছে ৬০টি। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাংকের বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়ায় বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তার ওপর করোনাভাইরাস আতঙ্কে পুঁজিবাজারে টানা দরপতন আরো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এ সময় ব্যাংকগুলো বিনিয়োগে এগিয়ে এলে বাজার স্থিতিশীলতায় সেটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখত বলে জানান তারা।

ব্যাংকের বিনিয়োগের বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) শেয়ারহোল্ডার পরিচালক মো. রকিবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যাংকগুলো তাদের প্রয়োজনের সময় পুঁজিবাজার থেকে আইপিও, রাইট শেয়ার ও বছর বছর লভ্যাংশ হিসেবে বোনাস শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ করেছে। আইপিওতে আসার আগে ব্যাংকগুলোর পরিশোধিত মূলধন কত ছিল আর বর্তমানে মূলধন কত হয়েছে, সেটি পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে, ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজার থেকে কত টাকা সংগ্রহ করেছে। ২০১০ সালের ঊর্ধ্বমুখী বাজারে ব্যাংকের পরিচালকেরা চড়া দামে শেয়ার বিক্রি করে লাভবান হয়েছেন। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য তহবিল গঠনের সুযোগ রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার জারির পর এক মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও অধিকাংশ ব্যাংক এতে সাড়া দেয়নি। করণীয় কী হতে পারে সে বিষয়ে ব্যাংকগুলোর সংগঠনের নেতারা একবারের জন্যও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেননি।

তার প্রশ্ন, ব্যাংকগুলো কি শুধু পুঁজিবাজার থেকে সুবিধাই নেবে? বাজারের প্রতি তাদের কোনো দায়িত্ব নেই? সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা আসার পরও তহবিল গঠনে গড়িমসি করে কীভাবে? ২০০ কোটি টাকা একটি ব্যাংকের জন্য কিছুই না। আমি আশা করব ব্যাংকগুলো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। (খবর : দৈনিক বণিক বার্তা, ১৬ মার্চ, ২০২০)