একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে তৈরি পণ্যের প্রধান রফতানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। আবার অঞ্চলভিত্তিক হিসাব করলে বাংলাদেশী পণ্যের সবচেয়ে বড় রফতানি বাজার ইউরোপ। পশ্চিমা এসব দেশের সবই এখন নভেল করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) মহামারীতে আক্রান্ত। এ পরিস্থিতিতে এমনিতেই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে থাকা রফতানি খাত আরো বড় সংকটে পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট রফতানির ১৬ দশমিক ৯৬ শতাংশই হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশটিতে রফতানি হয়েছে ৬৮৭ কোটি ডলারের পণ্য। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) দেশটিতে রফতানি কমেছে ২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ঋণাত্মক রফতানি প্রবৃদ্ধির মধ্যেই করোনাভাইরাস হানা দিয়েছে বাংলাদেশী পণ্যের সবচেয়ে বড় এ গন্তব্যদেশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হালনাগাদ তথ্য বলছে, গতকাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে কভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৭৮। পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই সঙ্গে যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ডসহ ইউরোপের সবক’টি দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে দেশটির সরকার।
যুক্তরাষ্ট্রের পর বাংলাদেশী পণ্যের দ্বিতীয় বৃহৎ বাজার ইউরোপের দেশ জার্মানি। বাংলাদেশের মোট রফতানির ১৫ দশমিক ২৩ শতাংশ যায় দেশটিতে। যদিও চলতি অর্থবছরের আট মাসে দেশটিতে ৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ রফতানি কমেছে। ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশটিতেও ছড়িয়ে পড়েছে নভেল করোনাভাইরাস। গতকাল পর্যন্ত দেশটিতে ৩ হাজার ৬২ জন এ রোগে আক্রান্ত বলে নিশ্চিত করেছে ডব্লিএইচও। করোনা মোকাবেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে দেশটিতে। বাতিল করা হয়েছে সব ধরনের ক্রীড়া আসর। চলাচলেও আরোপ করা হয়েছে কড়াকড়ি। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন দেশের রফতানিকারকরা।
এফবিসিসিআই সহসভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যমান রফতানি পতন পরিস্থিতি খুবই আশঙ্কাজনক। বিশ্ববাজারে অঘোষিত মন্দা চলছে। এটা বেশি দেখা যাচ্ছে ইউরোপের বাজারে, যেখানে আমাদের ৬০ শতাংশ পণ্য রফতানি হয়। ইউরোপে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কতদিন থাকবে, তা বলা যাচ্ছে না। ফলে আরো ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশে তৈরি পণ্যের তৃতীয় বৃহত্তম বাজার যুক্তরাজ্য। দেশের মোট রফতানির ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা দেশটিতে। যদিও চলতি অর্থবছরের আট মাসে যুক্তরাজ্যে রফতানি কমেছে শূন্য দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। ইউরোপের এ দেশেও বাড়ছে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। গতকাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে কভিড-১৯ শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৮০২। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইউরোপের অন্য দেশগুলোর মতো পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ভাবছে ব্রিটিশ সরকার।
বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের চতুর্থ বড় বাজার স্পেন। দেশের মোট রফতানির ৬ দশমিক ৩ শতাংশ যায় স্পেনে। চলতি অর্থবছরের আট মাসে দেশটিতে রফতানি ৪ দশমিক ১২ শতাংশ বেড়েছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সেখানেও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে এখন। স্পেনে গতকাল পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ২৩১। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ১৫ দিনের জন্য পুরো দেশ ‘লকডাউন’ ঘোষণা করেছে স্পেন সরকার। এই ১৫ দিন খাদ্য সংগ্রহ ও কাজের প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে যেতে পারবে না। জরুরি অবস্থার কারণে এরই মধ্যে ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে মাদ্রিদ। বন্ধ রয়েছে সেখানকার সব রেস্তোরাঁ ও দোকানপাট।
রফতানি পণ্যের পঞ্চম বৃহত্তম গন্তব্য ইউরোপের ফ্রান্স। গত অর্থবছর বাংলাদেশ থেকে মোট রফতানির ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশই গেছে ফ্রান্সে। দেশটিতে চলতি অর্থবছরে রফতানি কমেছে ১১ দশমিক ২৭ শতাংশ। এরই মধ্যে ফ্রান্সেও করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ৬৪০ ছাড়িয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় এরই মধ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে দেশটিতে। সেই সঙ্গে কোনো স্থানে ১০০-এর বেশি মানুষের সমাগম নিষিদ্ধ করেছে সরকার।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে এখন ইতালিতে সবচেয়ে বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। ডব্লিউএইচও বলছে, দেশটিতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১৭ হাজার ৬৬০। করোনা মোকাবেলায় কয়েক দিন ধরে পুরোদমে লকডাউন চলছে ইতালিতে। যথোপযুক্ত পেশাগত বা স্বাস্থ্যগত কারণ না থাকলে সবাই ভ্রমণ এড়িয়ে চলছে সেখানে। আগামী ৩ এপ্রিল পর্যন্ত চলাচলে এ সীমাবদ্ধতা আরোপিত থাকবে। ওই সময় পর্যন্ত বন্ধ থাকছে দেশটির স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। বাংলাদেশের মোট রফতানির ৪ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশের গন্তব্য ইতালির এ পরিস্থিতি উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে তুলেছে রফতানি খাতে।
বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে আমরা এখন মারাত্মক পরিস্থিতির মুখোমুখি। ব্র্যান্ডগুলো ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিচ্ছে এবং অব্যবহূত কাপড় ধরে রাখতে বলছে। বৈশ্বিক চাহিদা স্থবির বলে যারা উৎপাদনে আছে, তাদের জাহাজীকরণ থেকে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে। যার প্রভাবে আসন্ন তারল্য সংকটে পরিণতি হবে গুরুতর। উৎপাদনমুখী ইউনিটগুলো আর্থিকভাবে ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। ঈদের ঠিক আগে যখন আমাদের বোনাসও পরিশোধ করতে হবে। এ পরিস্থিতিতে শিল্পের জন্য সম্ভাব্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রফতানি কমে যাওয়া ও জাহাজীকরণে ব্যর্থতা।
বিশ্ব অর্থনীতির শ্লথতায় প্রধান গন্তব্যগুলোতে রফতানি এরই মধ্যে কমেছে। তার ওপর বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ মহামারী দেখা দেয়ায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে একের পর এক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছে। গতকাল যুক্তরাজ্য ব্যতীত ইউরোপের সব দেশের সঙ্গে উড়োজাহাজ যোগাযোগ বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। প্রধান রফতানি গন্তব্যগুলোয় করোনা আক্রান্তের ব্যাপ্তি যত দ্রুত বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে বাণিজ্য অনিশ্চয়তাও।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ইউরোপের বাজারেই রফতানি প্রবৃদ্ধি বেশি নেতিবাচক। পাশাপাশি অপ্রচলিত বাজারগুলোয়ও রফতানির অবস্থা ভালো নয়। ভবিষ্যতের কথা এখন বলা যাচ্ছে না।
দেশের তৈরি পোশাক খাতের ওভেন পণ্য তৈরির আনুমানিক ৬০ শতাংশ কাপড় এবং নিট পণ্য তৈরির আনুমানিক ১৫-২০ শতাংশ কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি হয়। এছাড়া নিট ও ডায়িংয়ের কেমিক্যাল ও অ্যাকসেসরিজের ৮০-৮৫ শতাংশও আমদানি হয় দেশটি থেকে। করোনাভাইরাসের উত্পত্তিস্থল চীনও বাংলাদেশী রফতানি পণ্যের গুরুত্বপূর্ণ বাজার। বাংলাদেশের মোট রফতানির ২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ যায় দেশটিতে। গতকাল পর্যন্ত চীনে করোনা আক্রান্তের নিশ্চিত সংখ্যা ছিল ৮১ হাজার ২১। এ পরিস্থিতিতে দেশটি থেকে আমদানি ও জাহাজীকরণ বন্ধ রয়েছে। ফলে ওভেন ও নিট দুই ধরনের পণ্য প্রস্তুতকারকই সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করছেন।
উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাজার কানাডা। বাংলাদেশের মোট রফতানির ৩ দশমিক ৩১ শতাংশ হয় এ দেশে। দেশটিতে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। গতকাল পর্যন্ত কানাডায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭৬।
এদিকে ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডসে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৮০৪ জনে পৌঁছেছে গতকাল। বাংলাদেশের মোট পণ্য রফতানির ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ যায় নেদারল্যান্ডসে। দেশটিতে বাংলাদেশের রফতানি এরই মধ্যে কমেছে ১ দশমিক ১৭ শতাংশ।
বাংলাদেশের মোট রফতানির ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ হয় ইউরোপের আরেক দেশ বেলজিয়ামে। দেশটিতে এরই মধ্যে বাংলাদেশের রফতানি কমেছে ৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। বেলজিয়ামেও গতকাল পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫৯৯।
রফতানি খাতের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বণিক বার্তাকে বলেন, এরই মধ্যে চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হয়েছে। এখন ইউরোপে করোনা ছড়িয়ে পড়ায় ওই বাজারের ক্রেতারা ক্রয়াদেশ আংশিক কমিয়ে আনার পাশাপাশি চলমান ক্রয়াদেশের উৎপাদন বন্ধ রাখতে বলছে। আর ভবিষ্যৎ ক্রয়াদেশ নিয়ে কোনো পূর্বাভাসই পাওয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে রফতানি খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়াবহ শঙ্কা দেখা দিয়েছে। (খবর : দৈনিক বণিক বার্তা, ১৫ মার্চ, ২০২০)