করোনা আতঙ্কে ধস বৈশ্বিক পুঁজি ও পণ্যবাজারে

নিউজ ডেস্ক মার্চ ১০, ২০২০, ০৮:৫১ এএম

১৯৮৭ সালের ১৯ অক্টোবর। দিনটি ছিল সোমবার। ভয়াবহ এক ধসের মুখে পড়ে বৈশ্বিক পুঁজিবাজার। মার্কিন পুঁজিবাজারের সূচক ডাও জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজের পতন ঘটে এক ধাক্কায় এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি। অন্য বড় বাজারগুলোতেও দেখা গিয়েছিল প্রায় একই পরিস্থিতি। বৈশ্বিক আর্থিক ইতিহাসে দিনটিকে এখন স্মরণ করা হয় ‘ব্ল্যাক মানডে’ হিসেবে।

অনেকটা সেই ‘ব্ল্যাক মানডে’রই পুনরাবৃত্তি ঘটল গতকাল। করোনাজ্বরে গতকাল বড় আকারের ধস দিয়ে শুরু হয় বৈশ্বিক পুঁজি ও পণ্যবাজারের সাপ্তাহিক লেনদেন। আর এ ধসকে আরো অবশ্যম্ভাবী করে তোলে জ্বালানি তেলের বাজারে সৌদি আরবের হাতে আকস্মিক মূল্যযুদ্ধের সূচনা।

কভিড-১৯ আতঙ্কে বৈশ্বিক শিল্পোৎপাদন এখন এমনিতেই পড়তির দিকে। এর ধারাবাহিকতায় চাহিদা কমতে থাকায় ধুঁকছিল জ্বালানি তেলের বাজারও। এর মধ্যেই বাজারে নতুন করে বিপত্তির সৃষ্টি করেছে সৌদি আরব ও রাশিয়ার মধ্যে শুরু হওয়া আকস্মিক মূল্যযুদ্ধ। ফলে গতকাল ২৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দরপতনের মধ্য দিয়ে গেছে বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের বাজার।

দিনব্যাপী লেনদেনের শুরুতেই গতকাল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের দাম এক ধাক্কায় সাড়ে ৩১ শতাংশ হ্রাস পেয়ে নেমে আসে প্রতি ব্যারেল ৩১ ডলার ২ সেন্টে। ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারির পর এবারই প্রথম এত বড় মাত্রায় দরপতনের মধ্য দিয়ে গেল পণ্যটি। অন্যদিকে মার্কিন বাজার আদর্শ ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) প্রায় সাড়ে ২৭ শতাংশ কমে নেমে  আসে প্রতি ব্যারেল ৩০ ডলারে। পরে মূল্য কিছুটা বাড়লেও তা একেবারেই সামান্য।

নভেল করোনাভাইরাস এবং জ্বালানি তেলের বাজারের ধস—এ দুয়ের যুগপৎ সংক্রমণে বৈশ্বিক শেয়ারবাজারে গতকাল দেখা দেয় টালমাটাল পরিস্থিতি। যুক্তরাষ্ট্রে গতকাল দিনব্যাপী লেনদেনের শুরুতেই ডাও জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ সূচকের পতন ঘটে ১ হাজার ৮০০ পয়েন্টেরও বেশি। এসঅ্যান্ডপি-৫০০ সূচকের পতন ঘটে প্রায় ৭ শতাংশ।

দিনের শুরুতেই ধসের এ অস্বাভাবিক গতি আতঙ্কিত করে তোলে বিনিয়োগকারীদের। নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের প্রথম ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই প্রয়োজন পড়ে সার্কিট ব্রেকিংয়ের (কেনাবেচার গতি হ্রাস বা লেনদেন বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের বাজারের প্রকৃত পরিস্থিতি অনুধাবন ও এর ভিত্তিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ করে দেয়া)। প্রায় ১৫ মিনিট ধরে বন্ধ রাখার পর গতকাল স্থানীয় সময় অনুযায়ী সকাল পৌনে ১০টার দিকে আবার লেনদেন শুরু হয় বাজারটিতে।

লন্ডনে গতকাল লেনদেনের শুরুই হয়েছে শীর্ষ ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর বাজারসূচক বেঞ্চমার্ক এফটিএসই-১০০-এর ৯ শতাংশ পতনের মধ্য দিয়ে। পরবর্তী সময়ে এ দরপতনের হার কিছুটা কমে নেমে আসে ৮ দশমিক ৩ শতাংশে। ইউরোজোনের মধ্যে ফ্রাংকফুর্ট ডিএএক্স ৩০ সূচকের পতন হয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। প্যারিসে সিএসি ৪০ সূচক হ্রাস পেয়েছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ।

তবে সবচেয়ে বড় ঝড় গেছে ইতালির শেয়ারবাজারের ওপর দিয়ে। লেনদেনের শুরুতেই গতকাল মিলানের এফটিএসই এমআইবি ইনডেক্সের পতন হয় ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। পরে এই পতনের হার নেমে আসে সাড়ে ৮ শতাংশে।

একই পরিস্থিতি এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার শেয়ারবাজারেরও। টোকিওতে নিক্কেই-২২৫ সূচকের পতন হয়েছে ৫ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। হংকংয়ের শেয়ারবাজারে পতনের মাত্রা ছিল তুলনামূলক অনেক কম, ৪ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে কভিড-১৯-এর কারণে তলানিতে এসে ঠেকা সাংহাই কম্পোজিট ইনডেক্সের পতন হয়েছে ৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। সিডনির শেয়ারবাজার সূচক হ্রাস পেয়েছে সোয়া ৭ শতাংশেরও বেশি।

জ্বালানি তেলের মূল্যযুদ্ধের সূচনা ঘটিয়ে স্বস্তি পায়নি সৌদি আরব নিজেও। ৯ শতাংশের বেশি পতন ঘটেছে দেশটির শেয়ারবাজারেও।

প্রতিবেশী ভারতে মুম্বাইয়ের এসঅ্যান্ডপি বিএসই সেনসেক্স সূচকের গতকাল পতন হয়েছে ১ হাজার ৯৪২ পয়েন্ট বা ৫ শতাংশেরও বেশি। অন্যদিকে ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে নিফটি৫০ ইনডেক্সের পতন হয়েছে ৫৩৮ পয়েন্ট বা ৫ শতাংশ।

মন্দা দেখা দিয়েছে বন্ড ও বিনিয়োগযোগ্য অন্যান্য আর্থিক ইন্সট্রুমেন্টের বাজারেও। যুক্তরাষ্ট্রে গতকাল ১০ বছর মেয়াদি সরকারি বন্ডের ইল্ড নেমে এসেছে রেকর্ড সর্বনিম্নে। একই চিত্রের পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে অন্য সবখানেই।

এ বিষয়ে মুম্বাইভিত্তিক বাজার উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান কেদিয়া অ্যাডভাইজরির প্রধান অজয় কেদিয়া বলেন, পুঁজি, পণ্য ও মুদ্রাবাজারে ব্যাপক ধসের পরিপ্রেক্ষিতে গোটা আর্থিক বাজারের জন্যই এক অন্ধকার দিন হয়ে থাকল আজকের দিনটি।

অন্যদিকে কিটকোডটকমের সিনিয়র অ্যানালিস্ট জিম উইঅফ গতকাল এক রিসার্চ নোটে বলেন, সাপ্তাহিক লেনদেনের শুরুই হয়েছে ঝুঁকি এড়ানোর ব্যাপক প্রবণতার মধ্য দিয়ে। বৈশ্বিক পুঁজিবাজারে ধস নেমেছে। ব্যাপক বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে মুদ্রা ও পণ্যবাজার।

বিশ্ববাজারের এ ধস বিনিয়োগকারীদের এখন ঠেলে দিচ্ছে সেফ হ্যাভেন বা আপত্কালীন বিনিয়োগের দিকে, ফলে দাম বাড়ছে স্বর্ণের। ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে ইয়েনের বিনিময় হার।

নিউইয়র্কের কমোডিটি এক্সচেঞ্জে (কোমেক্স) গতকাল এপ্রিলে সরবরাহের চুক্তিতে স্বর্ণের দাম ১১ ডলার ৭০ সেন্ট বেড়ে প্রতি আউন্স বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৬৮৪ ডলারে। দিনব্যাপী লেনদেনের একপর্যায়ে মূল্যবান ধাতুটির দাম ১ হাজার ৭০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বর্ণের দামের এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মূলে রয়েছে বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। বিশ্ব অর্থনীতি এখন মন্থর। পুঁজিবাজারে ধস, জ্বালানি তেলের বাজারে মন্দা, ভোগ্যপণের বাজারে অস্থিতিশীলতা, নড়বড়ে আর্থিক খাতের কারণে মানুষ এখন নিরাপদ বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছে। আর এ নিরাপদ বিনিয়োগের সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হলো স্বর্ণ। সুদমুক্ত বিনিয়োগ হওয়ায় বৈশ্বিক অর্থনীতির ঝুঁকি স্বর্ণে বিনিয়োগে খুব একটা অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে না। ফলে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে আপত্কালীন বিনিয়োগ হিসেবে এর চাহিদা থাকে বেশি। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে দামও।

বৈশ্বিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন দেশে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে নানা প্রণোদনা ঘোষণা বা ঘোষণার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তার পরও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কভিড-১৯-এর চাপের কারণে মহামন্দার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন বাজারসংশ্লিষ্টরা।

মুডি’স গতকাল জানিয়েছে, নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে বিশ্বব্যাপী চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতিতে ধস নেমেছে। ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা বাড়ছে।

মেলবোর্নভিত্তিক ওয়েব ট্রেডিং প্লাটফর্ম পেপারস্টোনের হেড অব রিসার্চ ক্রিস ওয়েস্টন বলেন, মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবখানেই দেখা গেছে (কভিড-১৯-এর) আতঙ্কের প্রভাব। আমি এমনটা অনেক বছর দেখিনি।

অন্যদিকে বিশ্বের বৃহত্তম বন্ড ট্রেডার প্রতিষ্ঠান পিমকোর প্রধান অর্থনীতিবিদ জোয়াকিম ফেলসের মতে, চাহিদা-সরবরাহে কভিড-১৯-এর বিরূপ প্রভাবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে অর্থনীতিতে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি দেখা যাবে। বিশেষ করে চীনের শিল্পোৎপাদন পরিস্থিতির দুরবস্থা এবং বৈশ্বিক পর্যটন খাতের ধস এক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।

ব্যবহারিক তথা শিল্পধাতুর বাজারেও গতকাল ধস অব্যাহত ছিল। নভেল করোনাভাইরাস ও জ্বালানি তেলের আকস্মিক মূল্যযুদ্ধের কারণে এ বাজারেও স্পষ্ট ছিল ব্ল্যাক মানডের প্রভাব। লন্ডন মেটাল এক্সচেঞ্জে (এলএমই) গতকাল তামার মূল্য নেমে আসে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের পর সর্বনিম্নে। চীনের সাংহাই ফিউচার্স এক্সচেঞ্জে (এসএইচএফই) পণ্যটির দাম নেমেছে সোয়া তিন বছরে সর্বনিম্নে। এলএমইতে একই সঙ্গে অব্যাহত ছিল অ্যালুমিনিয়াম, নিকেল, দস্তা, সিসা ও টিনের দরপতন।

ব্ল্যাক মানডের ঝাঁজ টের পেয়েছে বৈশ্বিক খাদ্যশস্য ও কৃষিপণ্যের বাজারও। বিশ্বজুড়ে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মন্দার মুখে পড়েছে কৃষিপণ্যের বাজার। শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে (সিবিওটি) গতকাল গমের দাম নেমে এসেছে চার মাসে সর্বনিম্নে। তথৈবচ দশা ভুট্টা ও সয়াবিনেরও।

সিবিওটি প্রাইস ইনডেক্স অনুযায়ী, গতকাল প্রতি বুশেল (৬০ পাউন্ড) গম বিক্রি হয়েছে ৫ ডলার ৫ সেন্টে, যা গত বছরের নভেম্বরের পর সর্বনিম্ন। ভুট্টার দাম ২ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩ ডলার ৬৮ সেন্টে। সয়াবিনের দাম ২ দশমিক ১ শতাংশ কমে নেমে এসেছে ৮ ডলার ৭৩ সেন্টে।

এ বিষয়ে মেলবোর্নভিত্তিক কমনওয়েলথ ব্যাংক অব অস্ট্রেলিয়ার এগ্রিকালচারাল স্ট্র্যাটেজি বিভাগের পরিচালক টবিন গোরে বলেন, নভেল করোনাভাইরাস বৈশ্বিক পণ্যবাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের রেকর্ড দরপতন ঘটেছে। ব্যারেলপ্রতি ৩০ ডলারের নিচে নেমে গেছে জ্বালানিপণ্যটির দাম। এটা সামগ্রিক অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। কমিয়েছে কৃষিপণ্যের দাম।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কমে গেলে জৈব জ্বালানির চাহিদা কমতে শুরু করবে। এর ফলে দেশে দেশে জৈব জ্বালানির কাঁচামাল হিসেবে ভুট্টা ও সয়াবিনের মতো কৃষিপণ্যের চাহিদাও কমে আসতে পারে। এ আশঙ্কা থেকেই জ্বালানি তেলের রেকর্ড দরপতনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সিবিওটিতে গম, ভুট্টা ও সয়াবিনের দাম কমতে শুরু করেছে।

৩৬ দেশের অর্থনৈতিক জোট অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট গত সপ্তাহে জানায়, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে দেড় শতাংশ পর্যন্ত। অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সহায়তার জন্য বড় অংকের অর্থ এরই মধ্যে মজুদ করে রাখার কথা জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ)। অন্যদিকে ব্লুমবার্গের হিসাব অনুযায়ী, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির ক্ষতি দাঁড়াতে পারে ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলারে।

তবে আকস্মিক শুরু হওয়া জ্বালানি তেলের মূল্যযুদ্ধের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি সংস্থাগুলোর হিসাবে। ফলে অদূর ভবিষ্যতেই নিজ নিজ পূর্বাভাস সংশোধনের দিকে এগোতে পারে সংস্থাগুলো। (খবর : দৈনিক বণিক বার্তা, ১০ মার্চ, ২০২০)