দখল, দূষণ আর ভরাট হওয়ায় জয়পুরহাটের চার নদীই এখন অস্তিত্ব হারিয়ে মরা খাল। জয়পুরহাটের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা নদী চারটি হলো- ছোট যমুনা, হারাবতী, তুলসীগঙ্গা ও চিরিনদী। ছোট যমুনার উৎপত্তিস্থল দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার বড় চণ্ডীপুর বিল থেকে। তুলসীগঙ্গা ও হারাবতী নদী দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ ও ঘোড়াঘাট উপজেলার নিম্নাঞ্চল থেকে শুরু হয়ে প্রথমে ছোট যমুনা, পরে নওগাঁ জেলার আত্রাই নদীতে মিলিত হয়েছে। আর ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে উৎপত্তি হওয়া চিরিনদী জেলার পাঁচবিবি উপজেলার কল্যাণপুর থেকে শুরু হয়ে প্রথমে ছোট যমুনা, পরে আত্রাই নদীতে মিশেছে।
জেলার পাঁচবিবি উপজেলার কল্যাণপুর থেকে শুরু করে আক্কেলপুর পর্যন্ত ৫৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য চিরিনদীর। কিন্তু ৩০ কিলোমিটারে মিলবে না নদীর কোনো চিহ্ন। দখল হয়ে গেছে এ নদী। বর্ষার সময় যৎসামান্য পানি এ নদীতে এলেও দখলের কারণে চিরিনদী গতিপথ হারিয়েছে। বাকি ২৮ কিলোমিটার নদীর কিছু চিহ্ন চোখে পড়লেও তলদেশ ভরাট হওয়ায় কোনো পানি নেই। এগুলোও এখন দখলের পর্যায়ে। নদীর বুকে চাষ হচ্ছে বিভিন্ন ফসল।
এ নদী দুটিতে বর্ষা মৌসুমে পানি পাওয়া গেলেও খরা মৌসুমে কোনো পানি থাকছে না। দীর্ঘদিন খনন ও পাড় না বাঁধায় নদীটি একদিকে বেদখল হচ্ছে, অন্যদিকে নাব্য সংকটে হারাচ্ছে অতীত ঐতিহ্য। একই দশা হারাবতী নদীর। এ নদী দুটি উদ্ধার কিংবা খননে নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ। ছোট যমুনায় একসময় পালতোলা নৌকা চলত। নৌকায় করে নদীপথে ব্যবসায়ীদের সাংসারিক কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করার দৃশ্য দেখা যেত।
সকাল, দুপুর, বিকাল জেলেদের কোলাহলে মুখরিত থাকত নদীর দুই পাড়। সেই ছোট যমুনা নদী এখন মরা খাল। কোনো কোনো জায়গায় আবার মেলানো যাবে না নদীর কোনো অস্তিত্ব। নাব্য হারিয়ে একসময়ের প্রমত্তা ছোট যমুনা এখন বিলীন হতে বসেছে। নদীতে চাষাবাদ হচ্ছে ইরি-বোরো ধানসহ অন্যান্য ফসলের। আর তুলসীগঙ্গা দূষণে পরিণত হয়েছে ময়লার ভাগাড়ে। জয়পুরহাট জেলা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি খাল দিয়ে চিনিকলের বর্জ্য আক্কেলপুরের সোনামুখী এলাকার মধ্য দিয়ে মিশেছে তুলসীগঙ্গা নদীতে। এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে পৌরসভা, বিসিক শিল্পনগরী ও জামালগঞ্জের ছোট-বড় প্রায় ১০ হাজার পোলট্রি শিল্প ও হ্যাচারির বর্র্জ্য অপসারণের নর্দমা।
জামালগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ মোড় এলাকার সেতু, জিয়াপুর প্রাথমিক স্কুল-সংলগ্ন সেতু ও রাজকান্দা সেতু এলাকায় দেখা গেছে পোলট্রির বর্জ্যরে স্তূপ। প্লাস্টিকের বস্তায় করে খালের ওপরই ফেলা হচ্ছে মরা মুরগি, পচা ডিম। বিভিন্ন পশুপাখিকে দেখা যায় বর্জ্যগুলো নিয়ে টানাটানি করতে। ওইসব বর্জ্যরে কারণে কালো রং ধারণ করা পানি খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিশছে আক্কেলপুর উপজেলার সোনামুখী এলাকার তুলসীগঙ্গা নদীতে। নদী রক্ষা নিয়ে আন্দোলনকারী জয়পুরহাটের সংস্থা ‘নদী ঘোরাও নদীর পথে’র সভাপতি আহম্মেদ মকবুল হোসেন মুকুল জানান, জয়পুরহাটে নদীগুলো রক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কেউ এগিয়ে আসছে না।
যে যার মতো দখল, দূষণ করছে। আর ভরাট ও গতিপথ পরিবর্তন রোধে সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। নদী মরলে মানুষ, জীবজন্তু, পরিবেশ সবই মরবে বলে আক্ষেপ করেন তিনি। তিনি বলেন, এখনই সময় নদীগুলোকে রক্ষা করার। জয়পুরহাটে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী তাজমিনুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, এ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে চলা চারটি নদী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১২৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে এ বছর তুলসীগঙ্গা নদীর খনন এবং তীর রক্ষার কাজ শুরু হবে। পর্যায়ক্রমে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাকি নদীগুলোর কাজ শুরু করা যাবে। কাজ সম্পন্ন হলে নদীগুলোকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। (খবর : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৯ মার্চ, ২০২০)