ঋণ ও বিলখেলাপিদের প্রার্থিতা সহজ হচ্ছে

নিউজ ডেস্ক মার্চ ৪, ২০২০, ০৯:০৫ এএম

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (আরপিও) সংশোধন করে 'গণপ্রতিনিধিত্ব আইন, ২০২০' করার প্রস্তাব করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর আগে আইনটিতে দফায় দফায় সংশোধনী আনা হলেও প্রথমবারের মতো শিরোনাম পরিবর্তন করা হয়েছে। এতে ঋণ ও বিলখেলাপিদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগের দিন পর্যন্ত হালনাগাদ করার সুযোগ রাখা হয়েছে।

বিদ্যমান আইনে সাত দিন আগে খেলাপির অর্থ পরিশোধ না করলে তিনি প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পেতেন না। গত বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে কোম্পানির পরিচালক বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অংশীদারদের অর্থাৎ বড় ঋণখেলাপিদের আগের দিন পর্যন্ত হালানাগাদ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনের নতুন প্রস্তাবে সব ধরনের ঋণ ও বিলখেলাপির মনোনয়নপত্র জমার আগের দিন পর্যন্ত হালনাগাদ বা পরিশোধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে।

বিশ্নেষকরা ইসির এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেছেন, নির্বাচন ব্যবস্থাকে কলুষমুক্ত করতে খেলাপিদের বিষয়ে কঠোর হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ইসির এই সিদ্ধান্তে খেলাপিদের বিষয়ে তাদের উদারতাই প্রকাশ পাচ্ছে। এর ফলে নির্বাচনে আর মানসম্পন্ন প্রার্থী খুঁজে পাওয়া যাবে না। ব্যাংক ডাকাত আর লুটেরাদের দৌরাত্ম্য রাজনৈতিক অঙ্গনে আরও বাড়বে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম সমকালকে বলেন, বিগত সংসদ নির্বাচনের সময় বড় ঋণখেলাপিদের জন্য যে সুযোগ রাখা হয়েছিল, এবারের প্রস্তাবে তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে। তিনি বলেন, আরপিও বাংলা ভাষায় রূপান্তর হচ্ছে- এটাই বড় পরিবর্তন। এর বাইরে ছোটখাটো কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে ইসির প্রস্তাব চূড়ান্ত কিছু নয়। এটা মন্ত্রিসভায় উঠবে, তারপর সংসদে যাবে। সেখানে সংসদ সদস্যরা এ নিয়ে বিতর্ক করবেন।

সেখানে অনুমোদন দেওয়া হলে আইনে পরিণত হবে। তিনি জানান, ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত সংশোধনীসহ খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ইসি-সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, এক-এগারো সরকারের আমলে আরপিওতে বড় ধরনের সংশোধন করা হয়েছিল। তখন এই আইনের শিরোনামে পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হলে অন্যতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের তীব্র আপত্তির মুখে পিছু হটে তৎকালীন দায়িত্বে থাকা শামসুল হুদা কমিশন।

ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সর্বশেষ অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধে খেলাপি হওয়ার কারণে ৯৫ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিল ইসি। এর মধ্যে সর্বাধিক ৩৩ প্রার্থী ছিলেন বিএনপির। ইসির নিবন্ধিত অন্যান্য দলেও ঋণখেলাপিদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। তবে ওই তালিকায় আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের কারও নাম ছিল না। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ মনোনীতরা সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে তফসিল ঘোষণার আগে আগে ঋণ হালনাগাদ করে নিয়েছেন। ওই নির্বাচনে নিবন্ধিত ৩৯টি দলের ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মোট তিন হাজার ৬৫টি মনোনয়নপত্র জমা পড়ে। মনোনয়ন বাছাইয়ে ৭৮৬ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়।

এক-এগারোর সেনা সমর্থিত সরকারের আমলে ড. শামসুল হুদা কমিশনের প্রস্তাব ছিল- তিন মাস আগে ঋণ ও বিলখেলাপিদের হালনাগাদ থাকতে হবে। ওই সময়ে নানা আপত্তির মুখে পড়ে সেটি সাত দিন করা হয়। শামসুল হুদা কমিশনের সদস্য ড. এম সাখাওয়াত হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ইসির এ ধরনের প্রস্তাব উদ্দেশ্যমূলক। এতে নির্বাচন ব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তনের যে লড়াই নাগরিক সমাজ করছে তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
 
তিনি বলেন, অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের নির্বাচনী আইন অনেক মানসম্মত ও যৌক্তিক। এগুলো কার্যকর করার চেষ্টা না করে বাদ দেওয়ার চেষ্টা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তিনি বলেন, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগের দিন কে কোথায় খেলাপি তা খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে না। ফলে খেলাপিরা প্রার্থী হবেন এবং নির্বাচন শেষে কেউ আর এগুলো খুঁজতে যাবেন না। তিনি বলেন, ইসির এই পদক্ষেপে ব্যাংক ডাকাত ও লুটেরাদের প্রার্থী হওয়ার পথ সহজ হবে। একসময় রাজনীতিতে রাজনীতিবিদরা হারিয়ে যাবেন। ব্যাংক ডাকাতরা রাজনীতি পুরোপুরি দখলে নিয়ে নেবেন। মানসম্পন্ন প্রার্থী আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

আরপিও বাংলায় ভাষান্তর করার বিষয়ে এম সাখাওয়াত বলেন, বাংলা ভাষায় করা যেতে পারে তবে পাশাপাশি ইংরেজিও রাখতে হবে। কারণ এসব আইন আন্তর্জাতিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়ে থাকে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, এই প্রস্তাব পাস হলে চিহ্নিত খেলাপিরা কিছুটা বেশি সুবিধা পাবে। কারণ সাত দিন আগে ঋণ ও বিল খেলাপিদের হালনাগাদের বিধান বিদ্যমান আইনে রয়েছে। ফলে সম্ভাব্য একাধিক প্রার্থী আগেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা পরিশোধ করার তাগিদ অনুভব করতেন। এখন মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগের দিন হালনাগাদ করার সুযোগ দেওয়া হলে দল থেকে যিনি মনোনয়ন পাবেন তিনিই শুধু খেলাপি বিল ও ঋণ পরিশোধ করে প্রার্থী হয়ে যাবেন। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিনে সংশ্নিষ্ট নির্বাচন কর্মকর্তারা পুরোপুরি নির্বাচনী কার্যক্রমে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাদের পক্ষে খেলাপিদের বিষয়ে বিশেষ কিছু করার আর সময় থাকে না।

ইসি থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো খসড়ার সারসংক্ষেপে বাংলায় ভাষান্তরের পাশাপাশি পাঁচটি সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। নতুন প্রস্তাবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগের দিন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, টেলিফোন বা পানির বিলের বকেয়া পরিশোধ বা হালনাগাদ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে কৃষিকাজে নেওয়া ক্ষুদ্রঋণ এর আওতাভুক্ত হবে না।

খসড়া প্রস্তাবে নির্বাচনে ভোটকক্ষে প্রার্থীদের এজেন্টদের উপস্থিতি রেকর্ড রাখতে নতুন একটি উপধারা সংযোজন করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার নির্ধারিত ফরমে ভোটকক্ষে প্রতিনিধিদের হাজিরা লিপিবদ্ধ (রেকর্ড) করে রাখবেন। এ ছাড়া প্রার্থীদের জামানত ও রাজনৈতিক দলের ব্যয় দাখিলে ব্যর্থ হলে জরিমানার পরিমাণ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের জামানতের পরিমাণ বর্তমানে ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো ব্যয় বিবরণী দাখিলে ব্যর্থ হলে জরিমানার পরিমাণ ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এ ছাড়া সংশোধনীতে নির্বাচনে প্রার্থীদের ব্যয় মনিটরিংয়ের জন্য প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় এক বা একাধিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছে কমিশন। এসব কমিটি প্রার্থীদের ব্যয় পরিবীক্ষণ করতে পারবে। এতে বলা হয়েছে- প্রয়োজনীয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় পরিবীক্ষণ করার উদ্দেশ্যে, কমিশন প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার জন্য এক বা একাধিক নির্বাচনী ব্যয় পরিবীক্ষণ কমিটি গঠন করবেন। কমিটি কমিশন কর্তৃক জারিকৃত নির্দেশনা অনুসারে কোনো প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় পরিবীক্ষণ করতে পারবে।

আরপিওকে বাংলা ভাষান্তরের যৌক্তিকতা তুলে ধরে সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, সদ্য স্বাধীন একটি দেশের সংসদ নির্বাচন ও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়াবলি যথাযথভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সংবিধানের ক্ষমতাবলে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হিসেবে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ-১৯৭২ জারি করেন। ইতোমধ্যে অতিক্রান্ত ৪৭ বছরে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা পরিবর্তনের ধারাবাহিকতাকে আইনানুগ রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে আদেশটিতে বহুবার সংশোধন করা হয়েছে। এ ছাড়া ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) সাহায্যে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরুর জন্য সম্পূর্ণ নতুন নির্বাচনী পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াকে আদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রাখার লক্ষ্যে কখনও কোনো অনুচ্ছেদের আমূল পরিবর্তন, কখনও নতুন করে সংযোজন বা বিয়োজনের প্রক্রিয়ায় পূর্বের আদেশটির মৌলিকত্ব অনেকখানি বিনষ্ট হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন অনুচ্ছেদের সঙ্গে কিছুটা অসামঞ্জস্যতাও সৃষ্টি হয়েছে। এই বিষয়গুলোকে যথাযথভাবে সম্বোধন করার জন্য একটি নতুন আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা হয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ইসি উল্টো পথে হাঁটছে। ঋণ ও বিলখেলাপিদের বিষয়ে ইসির মনোভাব কঠোর হওয়া প্রয়োজন। উল্টো তারা খেলাপিদের প্রার্থী হওয়ার পথ সহজ করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, 'ইসিকে মলম পার্টি নিয়েও কাজ করতে হয়'- জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা সাম্প্রতিক এমন মন্তব্য করেছেন। তার এই মন্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে বলা যায়- এমন বক্তব্যের পর ইসি এই প্রস্তাব কীভাবে করে। তাদের কথা ও কাজে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থাকে কলুষমুক্ত করতে ইসিকে আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। সম্ভাব্য প্রার্থীদের হলফনামা নির্বাচনের এক মাস আগে জমা নেওয়ার বিধান করা উচিত। একই সঙ্গে আইন সংশোধন করে খেলাপিদের যাতে মনোনয়ন না দেওয়া হয় সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও বাধ্য করতে হবে। কারণ সব কাজ ইসির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। দলগুলোকে দায় নিতে হবে।

তিনি বলেন, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন আইনটি অত্যন্ত জরুরি। এই আইনটি করা সম্ভব হলে নির্বাচন ব্যবস্থায় ভালো কিছু পরিবর্তন আশা করা সম্ভব হবে। ( খবর : দৈনিক সমকাল, ০৪ মার্চ ২০২০)