ঢাকাঃ চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব চার্লি চ্যাপলিন। তার কর্মজীবন ও সৃজনশীলতায় রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিফলিত হতে দেখা যেত। আর সেই মত প্রকাশ করেই বিতর্কিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৩০ এর দশকে বিশ্ব রাজনীতিতে সেনাশাসিত জাতীয়তাবোধে বিরক্ত হয়েছিলেন।
তখন ভাবনা চিন্তা করতে থাকেন এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করার। চার্লি ও আডলফ হিটলারের মধ্যে চেহারাগত সাদৃশ্য ছিল। বিশ্বব্যাপী অনেকেই সেটা নজর করেছিলেনপ। এই দুজন মাত্র চারদিনের ব্যবধানে জন্মগ্রহণ করেন, দুজনেই দারিদ্রের মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠেন ও পরবর্তী সময়ে প্রসিদ্ধি লাভ করেন৷
দুজনেরই একই ধরনের টুথব্রাশ গোঁফ ছিল। এই শারীরিক সদৃশ্য চ্যাপলিনকে সেই সময় চলচ্চিত্রের গল্প রচনায় সাহায্য করে। তাঁর দ্য গ্রেট ডিক্টেটর- ছবিতে তিনি সরাসরি হিটলারকে ব্যঙ্গ করেন এবং ফ্যাসিবাদকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেন।
তিনি ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বযুদ্ধের সময় এই চলচ্চিত্রের চিত্রায়ন শুরু করেন। ওই ছবিতে তিনি সংলাপের ব্যবহার করেছিলেন যাতে ভালভাবে রাজনৈতিক বার্তা দিতে পারা যায়৷ সেই সময় হিটলারকে নিয়ে হাস্যরসাত্মক চলচ্চিত্র নির্মাণ খুবই বিতর্কিত হয়।ছবিতে চ্যাপলিন একই পোশাকে রেখে একজন ইহুদি নাপিতকেও দেখিয়েছিলেন।
দ্বৈত চরিত্রের অপর চরিত্রে তিনি “অ্যাডিনয়েড হিঙ্কেল”এর ভূমিকায় অভিনয় করেন, যাকে হিটলারের ব্যঙ্গরূপ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের একজন সমালোচক ছবিটিকে “বছরের সবচেয়ে প্রত্যাশিত চলচ্চিত্র” বলে উল্লেখ করেন এবং সেটি ওই যুগের সর্বোচ্চ আয়কারী চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে।
ছবিটির শেষ দৃশ্যে বিতর্কের জন্ম দেয়। চ্যাপলিন পাঁচ মিনিটের বক্তৃতার মধ্য দিয়ে ছবিটি শেষ করেন এবং ছবিতে যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বার্তা দেন। ১৯৪০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে চ্যাপলিন বেশ কিছু আইনি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন ৷ যার জন্য তার অনেক সময় ব্যয় হয় ও তার ভাবমূর্তির ব্যাপক ক্ষতি হয়।
ঝামেলার সূত্রপাত হয়ে ছিল উঠতি অভিনেত্রী জোন ব্যারির সঙ্গে তার সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। তিনি ১৯৪১ সালের জুন থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত ব্যারির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িত ছিলেন। তাদের আলাদা হয়ে যাওয়ার পর ব্যারি তাঁর নিজের আচরণের জন্য দুবার গ্রেফতারও হন। পরের বছর তিনি দাবী করেন যে তিনি চ্যাপলিনের ঔরসজাত সন্তান গর্ভে ধারণ করেছেন।
চ্যাপলিন এই দাবিকে মিথ্যা বলার পর ব্যারি তার বিরুদ্ধে পিতৃত্বের মামলা করেন। এদিকে তৎকালীন এফবিআই কর্তা জে. এডগার হুভার দীর্ঘ দিন ধরে চ্যাপলিনের রাজনৈতিক চিন্তাধারা বিষয়ে সন্দেহ করে আসছিলেন। তখন তিনি এই বিষয়টি কাজে লাগিয়ে তার বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার চালানোর সুযোগ নেন।
চ্যাপলিনকে নিয়ে বিতর্ক বাড়তে থাকে যখন শোনা যায় পিতৃত্বের মামলা দায়ের করার দুই সপ্তাহ পরে তিনি মার্কিন নাট্যকার ইউজিন ওনিলের ১৮ বছর বয়সী কন্যা উনা ওনিলকে বিয়ে করেন।চ্যাপলিনের বয়স ছিল তখন ৫৪।
১৯৪৬ সালের এপ্রিলে তিনি নতুন চলচ্চিত্রের কাজ শেষ করেন, যা ১৯৪২ সাল থেকে শুরু করেছিলেন। তাঁর নির্মিত সেই ছবিটি হল মঁসিয়ে ভের্দু৷ যা ছিল একটি ব্ল্যাক কমেডি চলচ্চিত্র, যেখানে একজন ফরাসি ব্যাংক কেরানি ভের্দু তার চাকরি হারিয়ে তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য বিত্তশালী বিধবা মহিলাদের বিয়ে করে তাদের খুন করতে শুরু করে।
চ্যাপলিনের এই চলচ্চিত্রের অনুপ্রেরণা ছিল অরসন ওয়েলস, যিনি তাঁকে কেন্দ্র করে ফরাসি সিরিয়াল কিলার অঁরি দেসির লঁদ্রুকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন৷ চ্যাপলিন সিদ্ধান্ত নেন যে এই বিষয়টি নিয়ে একটি “অসাধারণ হাস্যরসাত্মক চলচ্চিত্র” নির্মাণ করার৷
তবে চ্যাপলিন মঁসিয়ে ভের্দু ছবিতে পুঁজিবাদের সমালোচনা করে আবার তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ ফুটিয়ে তুলেন এবং যুক্তি প্রদর্শন করেন যে যুদ্ধ ও যুদ্ধাস্ত্রের মাধ্যমে গণহত্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁর এই মতাদর্শের কারণে ছবিটি ১৯৪৭ সালের এপ্রিলে মুক্তি পাওয়ার পর বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ছবির উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে চ্যাপলিনকে অবজ্ঞা করা হয় এবং তাঁকে নিষিদ্ধ করার জন্য বলা হয়।
মঁসিয়ে ভের্দু চ্যাপলিনের একমাত্র চলচ্চিত্র, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমালোচনামূলক ও ব্যবসায়িক, কোন দিক থেকেই সফল হয়নি। মঁসিয়ে ভের্দুর নেতিবাচক সমালোচনা চ্যাপলিনের ভাবমূর্তিতে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। জোন ব্যারির সঙ্গে কেলেঙ্কারির পাশাপাশি এই নেতিবাচকতার ফলে তাঁর বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট মতাদর্শ প্রচারের অভিযোগ ওঠে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে সহায়তার জন্য সেকেন্ড ফ্রন্ট খোলার লক্ষ্যে প্রচার চালান এবং বিভিন্ন সোভিয়েত-মার্কিন মৈত্রী গোষ্ঠীকে সমর্থন দেন। কয়েকজন সন্দেহভাজন কমিউনিস্টদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল এবং লস অ্যাঞ্জেলেসে সোভিয়েত কূটনীতিকদের অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
১৯৪০ এর দশকে আমেরিকার রাজনৈতিক অবস্থায় চ্যাপলিনের এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে লার্চার “মারাত্মক অনৈতিক” বলে অভিহিত করেন। এফবিআই আগেও তাঁকে দেশ ছাড়া করতে চেয়েছিল এবং ১৯৪৭ সালের শুরুর দিকে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। যদিও চ্যাপলিন তাঁর কমিউনিস্ট মতাদর্শের কথা অস্বীকার করেন এবং নিজেকে “শান্তিপ্রিয়” বলে দাবী করেন।
কিন্তু কমিউনিস্ট মতাদর্শকে দমন করার ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপকে জনগণের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন তিনি৷ এই বিষয় ছেড়ে দিতে অনিচ্ছুক চ্যাপলিন কমিউনিস্ট দলের সদস্যদের বিচারকার্য ও হাউজ অন-আমেরিকান আক্টিভিটি কমিটির কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেন।
গণমাধ্যমে তাঁর এই কর্মকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়ে৷ তখন তাঁকে নির্বাসিত করার প্রস্তাবও আসতে থাকে৷ এমন কি একথাও ওঠে – হলিউডে তাঁর অবস্থান আমেরিকার নৈতিক কাঠামোর জন্য ক্ষতিকর। মঁসিয়ে ভের্দু ব্যর্থ হওয়ার পরও চ্যাপলিন তাঁর রাজনৈতিক সংযোগ থাকলেও পরের ছবিতে রাজনৈতিক বিষয়বস্তু থেকে সরে আসেন।
পরের ছবি ‘লাইমলাইট’ ছিল একজন ভুলে যাওয়া কৌতুকাভিনেতা ও একজন যুবতী নৃত্যশিল্পীকে ঘিরে। যা তাঁর শৈশব ও তাঁর পিতামাতার জীবন তুলে ধরা হয়েছে এবং এটি শুধু তাঁর নিজের জীবনীকেন্দ্রিকই নয়, এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর ধীরে ধীরে কমে আসা জনপ্রিয়তাকেও তুলে ধরা হয়েছিল। এই সময় চ্যাপলিন সিদ্ধান্ত নেন যে এই ছবির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হবে লন্ডনে।
তাঁর পরিবারসহ ১৯৫২ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক থেকে যাত্রা করেন। পরের দিন অ্যাটর্নি জেনারেল জেমস পি. ম্যাকগ্রেনারি চ্যাপলিনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুনঃপ্রবেশের অনুমতি বাতিল করেন এবং বলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুনরায় প্রবেশ করতে হলে তাঁকে তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ ও নৈতিক আচরণ সম্পর্কিত একটি সাক্ষাৎকার দিতে হবে।
যদিও ম্যাকগ্রেনারি সংবাদ মাধ্যমেকে জানিয়েছিলেন, চ্যাপলিনের বিরুদ্ধে তার মামলাটি একেবারে সাজানো। কিন্তু মালান্ড পরে উল্লেখ করেন যে ১৯৮০ সালে প্রকাশিত এফবিআইয়ের নথির ভিত্তিতে চ্যাপলিনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুনঃপ্রবেশের বিপক্ষে মার্কিন সরকারের হাতে কোনও বাস্তব প্রমাণ ছিল না।
তিনি যদি আবেদন করতেন তবে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার লাভ করতে পারতেন। তবে ওই পরিস্থিতিতে চ্যাপলিনও নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত নেন , আর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখবেন না৷
যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর সম্পত্তি রয়ে গেলেও, চ্যাপলিন সংবাদ মাধ্যমকে তাঁর প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধের বিষয়ে কোন নেতিবাচক কথা বলা থেকে বিরত ছিলেন। এদিকে আমেরিকায় যতই তাঁর বিরুদ্ধে বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি বাড়তে থাকে চ্যাপলিন ও তাঁর চলচ্চিত্র ততই ইউরোপে সমাদৃত হতে থাকে৷ ১৯৫০ এর দশক জুড়ে তাঁকে ঘিরে বিতর্ক ছিল, বিশেষ করে কমিউনিস্টদের ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল-এর কাছ থেকে আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার গ্রহণ এবং চৌ এনলাই ও নিকিতা ক্রুশ্চেভের সঙ্গে দেখা করার জন্য।
তিনি ১৯৫৪ সালে তাঁর প্রথম ইউরোপীয় চলচ্চিত্র আ কিং ইন নিউ ইয়র্ক নির্মাণের প্রস্তুতি শুরু করেন। এতে তিনি নিজেই একজন নির্বাসিত রাজা চরিত্রে অভিনয় করেন, যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় চান এবং তাঁর চরিত্রটি কমিউনিজমের অভিযোগের সম্মুখীন হয়।
চ্যাপলিন চিত্রনাট্যে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা যুক্ত করেন। এভাবে দু’দশক কেটে যায়৷ যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে এসে এই দু’দশক সুইজারল্যান্ডে বাস করার পর অবশেষে উনিশশো বাহাত্তর সালের এপ্রিল মাসে অ্যামেরিকায় পা রেখেছিলেন চার্লি চ্যাপলিন৷ ।
কারণ সত্তর-এর দশক থেকে আমেরিকার রাজনৈতিক আবহাওয়া বদলে যেতে শুরু করে। চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে চার্লি চ্যাপলিনকে অস্কার পুরষ্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে খারাপ অভিজ্ঞতার কথা ভেবে তিনি তখন দ্বিধান্বিত ছিলেন মার্কিন মুলুকে যাওয়ার ব্যাপারে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্ত্রীর কথায় চার্লি চ্যাপলিন রাজি হন সেখানে যেতে৷
আগামীনিউজ/নাসির