ঢাকাঃ পুঁজিবাজারে বীমা খাতের শেয়ারমূল্যের অস্বাভাবিক উত্থান জুয়াকেও হার মানিয়েছে। চার মাসে প্রায় ৮ গুণ বেড়েছে কোনো কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম। করোনার মধ্যে যেখানে মানুষের বীমা করা কমেছে, সেখানে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দ্রুতগতিতে এ খাতের শেয়ারের দাম বেড়েছে।
এক্ষেত্রে সংঘবদ্ধভাবে কয়েকটি গ্রুপ মিলে শেয়ার কিনে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ওইসব শেয়ারের দাম বাড়িয়েছে। এখন বেশি দামে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে কেটে পড়তে শুরু করেছে চক্রটি।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চোখের সামনেই শুধু বীমা খাত দিয়েই শেয়ারবাজারকে গোরস্তানে পাঠানোর আয়োজন চলছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই।
সরকারি প্রতিষ্ঠান সমবায় অধিদফতরকেন্দ্রিক একটি চক্র, কোম্পানির উদ্যোক্তা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং কয়েকটি মার্চেন্ট ও ব্রোকারেজ হাউস এর সঙ্গে জড়িত। এর নেতৃত্বে রয়েছেন আবুল খায়ের হিরু নামে সমবায় অধিদফতরের এক ডেপুটি রেজিস্ট্রার। বাজারে এই নামটি এখন সবার মুখে মুখে। তবে বড় লেনদেন তিনি নিজের নামে করেননি।
নিজের স্ত্রী, সমবায়ের নামে ভুয়া কোম্পানি খুলে এবং অন্য লোকজনের নামে ব্যবসা করেছেন। বীমাকেন্দ্রিক কয়েকশ’ কোটি টাকার পোর্টফোলিও ম্যানেজ করছেন এই কর্মকর্তা। তার টাকার উৎস নিয়ে বাজার সংশ্লিষ্টরাই বিস্মিত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভুয়া করোনা পরীক্ষার মতো শেয়ারবাজারে এক শাহেদের উত্থান হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিভিন্ন কর্মকর্তা, সরকারি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা এবং তারকা খেলোয়াড়দের সঙ্গেও ছবি তুলে ফেসবুকে প্রচার করছেন তিনি। আবার ইউটিউব চ্যানেলে শেয়ারবাজার নিয়ে টকশো উপস্থাপনা করছেন। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে আলোচনায় এসেছেন তিনি।
তবে আবুল খায়ের হিরু দাবি করছেন, এই বাজারের সঙ্গে তার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। বিভিন্ন বীমা কোম্পানির শেয়ার লেনদেন করলেও কোনো কারসাজির সঙ্গে তিনি জড়িত নন।
বীমা শেয়ারের মূল্য নিয়ে এই কারসাজি সম্পর্কে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজারে লেনদেন ও শেয়ারের দাম বৃদ্ধি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সংঘবদ্ধভাবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে শেয়ারের দাম বাড়ানো হলে তা অস্বাভাবিক। আর কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়লে তা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, দাম বৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণ আছে কিনা, সেটি চিহ্নিত না হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন।
জানতে চাইলে বিএসইসি’র কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, কোম্পানির শেয়ারের দাম ওঠানামা করা শেয়ারবাজারের ধর্ম। তবে অস্বাভাবিক কিছু হলে কমিশন সেখানে ব্যবস্থা নিতে পারে। তিনি বলেন, বীমা খাতের শেয়ারের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে কারা জড়িত বিষয়টি জানতে হবে।
জানা যায়, গত চার মাসে শেয়ারবাজারে বীমা খাতের শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। এর মধ্যে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সসহ বেশকিছু বীমা কোম্পানির এমনভাবে বেড়েছে, যা জুয়াকেও হার মানায়। আর এই দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সমবায় অধিদফতের কর্মকর্তা আবুল খায়ের হিরুর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সংস্থার নজরে রয়েছেন তিনি। ৩১তম বিসিএসের এই কর্মকর্তা বর্তমানে সমবায় অধিদফতরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার।
গত বছরের ৯ জুলাই সহকারী রেজিস্ট্রার থেকে ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর জেলায়। এর আগে ঢাকা ও গাজীপুরে জেলা সমবায় কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। এর সঙ্গে জড়িত হয়েছে আরও কয়েকটি চক্র।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত চার মাসে শেয়ারবাজারে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের দাম সবচেয়ে ৮ গুণ বেড়েছে। এই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির ১৬ টাকা শেয়ার ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের বাজারমূল্য ৮০ কোটি টাকা থেকে সাড়ে ৫শ’ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী কোম্পানি সিডিবিএলের তথ্য অনুসারে এই কোম্পানির লেনদেনেই হিরুর সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ত। এক্ষেত্রে নিজের স্ত্রী সাদিয়া হাসানের নামে বিও অ্যাকাউন্ট খুলে কোম্পানির প্রায় ৩ শতাংশ শেয়ার লেনদেন করেছেন। যার বিও অ্যাকাউন্ট নম্বর ১২০৫৫৯০০৬৮২৮৪৯৭৩।
সাদিয়া হাসানের ইমেইল আইডি ব্যবহার করে ডিআইটি কো-অপারেশন লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলেছেন; যার বিও অ্যাকাউন্ট নম্বর ১২০৫৫৯০০৬৭৭৫৭৮১১। এই অ্যাকাউন্টে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের ২২ দশমিক ৪৫ শতাংশ শেয়ার লেনদেন করেছেন।
এর মধ্যে শেয়ার কিনেছে ১৪ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং বিক্রি করেছে ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ। এই ডিআইটি কো-অপারেশনের নামে এশিয়ার প্যাসিফিক ইন্স্যুরেন্সের ৫ কোটি এবং নিটোল ইন্স্যুরেন্সের নামে ৫০ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। কোম্পানিটিতে এ চক্রের সহযোগী মো. জসিম উদ্দিন তিনটি অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিকভাবে শেয়ার লেনদেন করেছেন। এক্ষেত্রে জসিম উদ্দিন নামে দুটি অ্যাকাউন্ট; যার নম্বর ১৬০৪৫৩০০৬৩৬৬৩৬৯৯ এবং ১৬০৪৫৩০০৬৩৬৬৩৭১২।
এছাড়াও শিক্ষিত বেকার কেন্দ্রীয় সংঘ নামে আরেকটি বিও অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। যার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসিম উদ্দিন নিজেই। এর নম্বর ১৬০৪৫৩০০৬৫৪৯৯৩৬২। এ তিন অ্যাকাউন্টে কোম্পানির ৭ দশমিক ১০ শতাংশ শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এছাড়াও নিজে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়ে চন্দ্র শিক্ষিত বেকার যুব বহুমুখী কো-অপারেটিভ সোসাইটি নামে আরও অ্যাকাউন্ট খুলেছেন জসিম উদ্দিন। যার নম্বর ১২০৫১৫০০৬৬০৫৭৫৬১।
এশিয়া ইন্স্যুরেন্স ছাড়াও অ্যাকাউন্টগুলোতে ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের ১০০ কোটি, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের ৩৫ কোটি, প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের ৩২ কোটি এবং নিটোল ইন্স্যুরেন্সের ৩৫ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে গ্রুপটি ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের ৩৫ শতাংশ, প্যারামাউন্টের ১২ শতাংশ, প্রভাতীর ১৪ এবং নিটোল ইন্স্যুরেন্সের ১২ শতাংশ শেয়ার লেনদেন করেছে।
এছাড়াও আলোচ্য সময়ে স্বনামধন্য একজন ক্রিকেট তারকাও তার নিজ অ্যাকাউন্টে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ শেয়ার লেনদেন করেছেন। যার অ্যাকাউন্ট নম্বর ১২০৪৪৮০০৬৪৯৭৬২৩৭। এ তারকার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় আবুল খায়ের হিরু এবং সাদিয়া হাসানের ছবি দেখা গেছে।
জানতে চাইলে আবুল খায়ের হিরু বলেন, ‘একটি আইটেম নিয়ে ক’টা টাকা ইনকাম করেছি, তাই মানুষের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এজন্য সবাই আমার নাম বলে। তবে আমি কোনো কারসাজির সঙ্গে জড়িত নই।’ তিনি বলেন, ‘আমি জড়িত থাকলে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা আমার বিরুদ্ধে এতদিনে ব্যবস্থা নিত।’
এত অ্যাকাউন্ট কিভাবে পরিচালনা করছেন এবং এ টাকার উৎস কী এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ডিআইটি কো-অপারেশন সমবায়ের অনেক লোকের প্রতিষ্ঠান। এখানে আমি একা নই।’ এর বেশি জানতে চাইলে সাক্ষাতে কথা বলতে হবে বলে জানান তিনি। এছাড়াও বাজারের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক বলে দাবি করেন সরকারি এ কর্মকর্তা।
বীমা কোম্পানির শেয়ারের দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে চক্রের অন্যতম সদস্য মো. মামুন সালাম। ১০টি বিও অ্যাকাউন্ট খুলে ৬টি বীমা কোম্পানির ৬৫ কোটি টাকার বেশি শেয়ার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এশিয়া প্যাসিফিক ইন্স্যুরেন্সের ৪০ শতাংশ, নিটোল ইন্স্যুরেন্সের ১০ এবং রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্সের ৮ শতাংশ শেয়ার লেনদেন করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে মামুন সালামের নিজ নামে ২টি অ্যাকাউন্ট। যার নম্বর ১২০২০৯০০১৯৫৩৬২৪৬ এবং ১২০৪০৯০০০০১১৩২১১। এ অ্যাকাউন্টে রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্সের ১০ কোটি, নিটোল ইন্স্যুরেন্সের ৯ কোটি এবং গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্সের ৮ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
এছাড়াও তার মা বেগম নুরজাহান সালামের নামে একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে যার নম্বর ১২০৫৫৯০০১৬৫১৫৭১২। এ অ্যাকাউন্টে সিটি জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের ৮ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন করা হয়েছে। এছাড়াও নিজের নামে আরও দুটি প্রতিষ্ঠান খুলেছেন মামুন সালাম। এর মধ্যে রিলায়েন্স অ্যাপারেলস লিমিটেড এবং সালাম অ্যাপারেলস লিমিটেড। রিলায়েন্সের নামে ১২০৫৫৯০০১৫২৪০৯১৭ জনতা ইন্স্যুরেন্সের ৮ কোটি টাকা এবং সালাম অ্যাপারেলসের নামে ১২০৫৫৯০০১৪৬০৬৮৮৬ নম্বর বিও অ্যাকাউন্টে রূপালী ইন্স্যুরেন্সের ১০ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন করা হয়েছে। এছাড়াও প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের নিজস্ব অ্যাকাউন্ট ১২০২৬৫০০০১১৫২১৫১ নম্বর অ্যাকাউন্টে নিটোল ইন্স্যুরেন্সের ৩৭ কোটি, ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের ২৬ কোটি এবং ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের ৮ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
প্যারামাউন্ট টেক্সটাইলের নামে ১২০৩১১০০৬৮৯৯৪৩২০ নম্বর অ্যাকাউন্ট খুলে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের ৮ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এ চক্রে আরও রয়েছে আবদুল কাইয়ুম ও তার সহযোগীরা। ক্ষেত্রে নিজ নামে তিনটি অ্যাকাউন্ট খুলেছেন আবদুল কাইয়ূম। যার নম্বর ১৬০২১৭০০৬৭২২৭৩৭৭, ১২০৪৫৯০০৬৪৮৫০২১৫ এবং ১২০৫০৩০০৬৩৪০১৪৩১। এছাড়াও কাইয়ূম ও সন্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলেছেন; যার প্রোপ্রাইটর তিনি নিজেই। এ প্রতিষ্ঠানের বিও অ্যাকাউন্টগুলোর নম্বর ১৬০২১৭০০৬৭২২৭২৭৮ এবং ১২০১৮৩০০৬৮০৫৩৭৬৩।
এছাড়াও নিজের স্ত্রী মরিয়ম নেসার নামে দুটি অ্যাকাউন্ট খুলেছেন, যার নম্বর ১২০৩০০০০৪৫৭৯৫৬৭৯ এবং ১৬০২১৭০০৬৮৪১১৩৫৫। শ্যালক আশরাফুল ইসলামের নামে দুটি অ্যাকাউন্টে শেয়ার লেনদেন করেছেন। এগুলো নম্বর ১২০৫২০০০৬৮২৫৫৩৮১ এবং ১৬০২১৭০০৬৮২৫৫৩৮১। এছাড়াও একই মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে মেসার্স কারিব ট্রেডার্স নামে আরও একটি বিও অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। যার নম্বর ১২০৩০০০০৬৮২৩০৮৮৮। অ্যাকাউন্টগুলোতে এশিয়া প্যাসিফিক ইন্স্যুরেন্সের ১১০ কোটি, নিটোল ইন্স্যুরেন্সের ৩০ কোটি এবং রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্সের ২২ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন করা হয়েছে।
কাইয়ূমের অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়টি বিএসইসিও চিহ্নিত করেছিল। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু তাকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। তবে তা আমলে নেয়নি চক্রটি।
বীমার শেয়ার নিয়ে স্বাভাবিক লেনদেনে আরও রয়েছেন লুৎফুল গনি টিুট। নিজের নামে খুলেছেন ৪টি বিও অ্যাকাউন্ট। এর নম্বর হল- ১২০৫৬৭০০৬৭৭৩৯৭০০, ১২০৬০৮০০৬৮৮৩৫৩৮৭, ১২০৩৭১০০১০২৩৯৭৬৪ এবং ১৬০১৭৬০০৪৬৮২২৩৮০। সাতরং এগ্রো ফিশারিজ নাম দিয়ে নিজের নামে একটি অ্যাকাউন্ট খুলেছেন, যার নম্বর ১২০১৯৫০০৬৪৮৪৫৫৫০। এছাড়াও নিজের স্ত্রী শাম্মী নেওয়াজের নামে আরও দুটি অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করছেন; যার নম্বর ১২০৬০৮০০৬৮৮৩৫৪৫১ এবং ১৬০১৭৬০০৪৬৮১৪৩৪১। অ্যাকাউন্টগুলোতে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের ৪৮ কোটি এবং ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের ২২ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
এক্ষেত্রে ৭টি অ্যাকাউন্ট মিলে প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের ৫২ শতাংশ এবং ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের ২২ শতাংশ লেনদেন করা হয়েছে। শুধু ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারী নয়, ব্রোকারেজ হাউসও জড়িত রয়েছে অস্বাভাবিক লেনদেনে। এক্ষেত্রে পিপলস সিকিউরিটিজ লিমিটেড তার নিজস্ব পোর্টফোলিও ১২০৩৯৮০০১৫৬০৫১৪৭ নম্বর বিও অ্যাকাউন্টে এশিয়া প্যাসিফিক ইন্স্যুরেন্সের ৬৫ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন করেছে। যা কোম্পানিটির মোট লেনদেনের ৪০ শতাংশের বেশি।
পাশাপাশি সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে বীমা খাতের অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটির দুটি অ্যাকাউন্টে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের ৭ দশমিক ১৬ শতাংশ শেয়ার লেনদেন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব পোর্টফোলিও ১২০১৫০০০০০০৬০৬৩৩ নম্বর অ্যাকাউন্টে ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস লিমিটেডের নামে খোলা ১৬০৫৫৩০০৪০৭৩২৭৪৭ নম্বর অ্যাকাউন্টে ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ শেয়ার লেনদেন করা হয়েছে।
শেয়ারবাজারে প্রাথমিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। বাজারে কোনো অনিয়ম হলে ডিএসই সবার আগে চিহ্নিত করে। কিন্তু বীমা খাতের শেয়ারের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির আচরণ সন্দেহজনক। কোনো অ্যাকাউন্ট থেকে বীমা খাতের শেয়ার বিক্রি করা হলে ওই অ্যাকাউন্টের তথ্য তলব করে পাঠায় প্রতিষ্ঠানটি। ডিএসইর ইনভেস্টিগেশন এবং এনফোর্সমেন্ট বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার আরিফুর রহমান চৌধুরী স্বাক্ষরিত ১৫টি চিঠি যুগান্তরের হাতে এসেছে।
এসব চিঠিতে এশিয়া প্যাসিফিক ইন্স্যুরেন্স, প্যারামাউন্ট, ফিনিক্স, সিটি জেনারেল, পিপলস, গ্লোবাল, সন্ধানী এবং এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার বিক্রির পর বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের তথ্য তলব করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের কাছে ওই হিসাবটির বিও অ্যাকাউন্ট খোলার ফরম, পোর্টফোলিও স্টেটমেন্ট এবং মার্জিন ঋণের চুক্তির কপি চাওয়া হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আরিফুর রহমান বলেন, ‘আমার স্বাক্ষরে যেসব চিঠি গেছে, সেটি আমার ইচ্ছায় নয়। আমার বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যিনি আছেন, তার নির্দেশে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।’
বাজারে দাম বৃদ্ধির তালিকায় অন্যতম কোম্পানি ছিল এশিয়া ইন্স্যুরেন্স। প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম উদ্যোক্তা সাউথইস্ট ব্যাংক। দাম বৃদ্ধির আগে ২ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানটির ২০ লাখ শেয়ার কেনার ঘোষণা দেয় সাউথইস্ট ব্যাংক। এর আগের দিন ১ সেপ্টেম্বর ৮ লাখ ৭৯ হাজার শেয়ার কেনার ঘোষণা দেন প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম পরিচালক মোহাম্মদ আলী খোকন। ১৬ আগস্ট ৮ লাখ শেয়ার কেনার ঘোষণা দেয় এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের আরেক উদ্যোক্তা বে-লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট।
এদিকে করোনার মধ্যে বীমা খাতের খারাপ অবস্থা। নতুন করে বীমা করার হার কমছে। এ অবস্থায় কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের আয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ১ টাকা ৬৫ পয়সা। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৪৪ পয়সা। অর্থাৎ, তিন মাসে আয় বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। এ ক্ষেত্রে হঠাৎ করে কেন আয় বাড়ল-এর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি কোম্পানিটি।
জানতে চাইলে এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমাম শাহীন বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা ভালো। দুটি কারণে আমাদের আয় বেড়েছে। প্রথমত, বীমায় কমিশনের হার কমিয়ে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। দ্বিতীয়ত, সেপ্টেম্বরে শেয়ারবাজার থেকে আমাদের আয় বেড়েছে। এ ছাড়া আমাদের উদ্যোক্তাদের ভাবমূর্তি ভালো রয়েছে। অন্যদিকে একই সময়ে গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারপ্রতি আয় ৪৪ পয়সা থেকে ৭ পয়সা বেড়ে ৫২ হয়েছে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের কারণে আয় বাড়লে সব কোম্পানির বাড়ার কথা। এ ছাড়াও করোনার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ হওয়ায় বীমা করার হার কমছে। সেখানে হঠাৎ করে এই কোম্পানি কীভাবে এতগুণ আয় করল, তার তদন্ত হওয়া জরুরি।
আগামীনিউজ/প্রভাত