বরাদ্দ ৪৫ ভাগ প্লটেই শিল্পপ্রতিষ্ঠান নেই

ডেস্ক রিপোর্ট অক্টোবর ৩০, ২০২০, ১০:৩৪ এএম
ছবি সংগৃহীত

ঢাকাঃ প্রতিষ্ঠার ৬৩ বছরেও দাঁড়াতে পারেনি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)। অদক্ষতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনার অভাব এবং দুর্নীতির কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানটির সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়নি।

বিসিকের আওতায় বরাদ্দ নেয়া বর্তমানে ৪৬০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানই রুগ্ন, যা মোট শিল্প ইউনিটের ৮ শতাংশ। ৪৫১টি খালি প্লট পড়ে আছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

বরাদ্দ পাওয়া উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ বলছেন, প্রভাবশালীদের চাঁদাবাজির কারণে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। একজন ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, সিরাজগঞ্জে তিনি একটি প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। কিন্তু সরকারের একজন লোক উচ্চহারে চাঁদা দাবি করছেন।

যে কারণে দীর্ঘদিনেও কারখানা স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অত্যন্ত সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান ছিল বিসিক। কিন্তু সময়োপযোগী বাস্তবমুখী পদক্ষেপের কারণে সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়নি।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, বিসিক একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠান। তারা বিভিন্ন জায়গায় শিল্পপ্লট করেছে। কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়নি।

কিছু ক্ষেত্রে এমন জায়গায় শিল্পনগরী করা হয়েছে, সেখানে মানুষ যেতে চায় না। কেউ কেউ বরাদ্দ পেলেও শিল্পনগরী না করে অন্য কাজ করছে। এ ছাড়া অনেক প্লট অবরাদ্দ রয়ে গেছে। এসব কারণে প্রতিষ্ঠানটির সংস্কারের সময় এসেছে।

বিসিক কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিষ্ঠানটি তারা ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। ইতোমধ্যে বেশ কিছু সেবা অনলাইনে দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কেউ শিল্পের নামে বরাদ্দ নিয়ে প্রতিষ্ঠান না গড়লে প্লট বাতিল করা হবে।

এ ব্যাপারে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার বলেন, বিসিক শিল্পনগরীতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উদ্যোক্তারা কারখানা স্থাপন করতে ব্যর্থ হলে প্লট বরাদ্দ বাতিল করে সেটি অবশ্যই অন্য উদ্যোক্তাকে দিতে হবে।

এ ছাড়া শিল্পকারখানা ব্যতীত অন্য কোনো ধরনের স্থাপনা রাখলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বিসিক। ১৯৫৭ সালের ৩০ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী থাকাকালে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কর্পোরেশন নামে যাত্রা শুরু করে।

সংস্থাটির মৌলিক কাজ মানুষের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে শিল্পোদ্যোক্তা সৃষ্টি। বিসিকে মোট শিল্পনগরীর সংখ্যা ৭৬। আর শিল্পপট ১০ হাজার ৫৯০। বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১০ হাজার ১৩৯টি। খালি প্লটের সংখ্যা ৪৫১টি। তবে বরাদ্দ প্লটের মধ্যে শিল্প ইউনিট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫ হাজার ৮৮৩টি। এরমধ্যে উৎপাদনে আছে ৪ হাজার ৭৩১টি, নির্মাণাধীন ৬৯২ এবং রুগ্ন বা বন্ধ শিল্পপ্লট ৪৬০টি।

রফতানিমুখী শিল্প ৯৪৬টি। বাকি ৪ হাজার ২৫৬টি প্রতিষ্ঠানই বরাদ্দ নিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেনি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত বিসিকের শিল্পনগরীতে বিনিয়োগ ২৭ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। পণ্য বিক্রি ৫০ হাজার ৬৮২ কোটি। এরমধ্যে রফতানি ২৪ হাজার ৭৫৫ কোটি। সরকারকে রাজস্ব দেয়া হয়েছে ২ হাজার ৩৭ কোটি টাকা।

বিসিকের দাবি তারা এ পর্যন্ত ৫ লাখ ৯০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে ৪৯৯ জন কর্মকর্তা এবং ১ হাজার ৯২ জন কর্মচারীসহ মোট জনবল ১ হাজার ৫৯১ জন। এখনও ৮১৯টি শূন্যপদ রয়েছে। ২৬ ধরনের ৫৬ কাজ করার কথা বিসিকের।

আর মূলকাজ শিল্পোদ্যোক্তা চিহ্নিত বা উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা। এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত গবেষণা, উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, পুঁজির জোগান ও পণ্য বিপণনে সহায়তা করা। এ ছাড়া ক্রেতা-বিক্রেতা সম্মেলন আয়োজন, উদ্যোক্তাদের কর কমানোর বিষয়ে পদক্ষেপ এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে সহায়তা এবং পণ্যের মানোন্নয়নে সহায়তা।

সবকিছু মিলিয়ে মূল উদ্দেশ্য হল-কম শিক্ষিত মানুষকে দক্ষ কারিগর হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি। দেশের ৬৪টি জেলায় তাদের নিজস্ব কার্যালয় স্থাপন করেছে বিসিক। সারা দেশে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ৪টি বিভাগে ৪টি আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপন করা হয়।

জানতে চাইলে বিসিকের শিল্প উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ বিষয়ক পরিচালক মো. খলিলুর রহমান বুধবার যুগান্তরকে বলেন, যারা শিল্পপট বরাদ্দ নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে বিসিকের জেলা কমিটি কাজ করে। আর জেলা প্রশাসকরা এই কমিটির দায়িত্বে থাকেন।

বিসিকের পরিকল্পনা ও গবেষণা বিষয়ক পরিচালক ড. মো. গোলাম ফারুক যুগান্তরকে বলেন, আমি দুই মাস হল এখানে এসেছি। ফলে গোছানো তথ্য নেই। তবে গবেষণায় কিছুটা সমস্যা রয়েছে। এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে।

তিনি বলেন, জনবলের ক্ষেত্রে আমাদের বড় সমস্যা। বেশিরভাগ কর্মকর্তাই পুরাতন। তারা অবসরের পথে। সাম্প্রতিক কিছু নতুন অফিসার যোগদান করেছেন। এদের সুষ্ঠ পরিকল্পনা করে কাজ এগিয়ে নেয়া হবে।

বিসিকের তথ্যানুযায়ী, প্লট মূলত ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেয়া হয়। উদ্যোক্তারা চাইলে একবারে প্লটের ইজারার পুরো অর্থ পরিশোধ করতে পারেন। আবার অর্ধেক নগদ এবং বাকিটা ৫ বছরে ১০ কিস্তিতেও পরিশোধ করতে পারেন।

তবে ৯৯ বছরের ইজারা হলেও যে কোনো শর্ত ভঙ্গ করলে বিসিক ওই প্লট বাতিল করতে পারে। তবে যারা বরাদ্দ পায়, তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নেয়া হয় না।

বিসিক সূত্র বলছে, বর্তমানে ঢাকা বিভাগের আওতাধীন শিল্পনগরগুলোয় সবচেয়ে বেশি প্লট অব্যবহৃত পড়ে আছে। শিল্পকারখানা করার মতো প্লট এখানকার শিল্পনগরগুলোয় ফেলে রেখেছেন পট-মালিকরা।

আগামীনিউজ/জেহিন