বিজেএমসি পাটকল বন্ধ

পাট ক্রয় কেন্দ্রে সুনসান নীরবতা

রাকিব হাসনাত, জেলা প্রতিনিধি অক্টোবর ১১, ২০২০, ১২:৩৯ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

পাবনা: দেশের উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পাবনা বেড়া বাজার পাট ক্রয়কেন্দ্রে ভরা মৌসুমে সুনসান নীরবতার মত অবস্থা তৈরি হয়েছে। হাজার হাজার পাট ব্যবসায়ীদের পদচারণায় মুখর হয়ে থাকত এ পাটের হাট ও পাট ক্রয়কেন্দ্র। পাটকল বন্ধ করে দেওয়ায় একদিকে ব্যবসায়ীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন অন্যদিকে কাজ হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন কারখানায় কর্মরত শত শত শ্রমিক-কর্মচারী।

পাটশ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা জানান, পাবনার বেড়া-সাঁথিয়া ও সুজানগর উপজেলায় প্রচুর পাট উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত পাটের ওপর ভিত্তি করে বেড়ায় গড়ে উঠেছিল উত্তরাঞ্চলের প্রসিদ্ধ পাট ব্যবসাকেন্দ্র। এক সময় বেড়ায় বিজেএমসির ১০ থেকে ১২টি পাটকলের পাট ক্রয়কেন্দ্র ছিল। বেড়া উপজেলার বেড়া বাজারের পাট ক্রয়কেন্দ্রের খ্যাতি ছিল উত্তরাঞ্চল জুড়ে। একসময় বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন (বিজেএমসি) প্রায় সবগুলো পাটকলের ক্রয়কেন্দ্র ছিল এখানে। বেসরকারি পর্যায়েরও কয়েকটি পাটকলের ক্রয়কেন্দ্র ছিল এখানে। এখান থেকে পাট কিনে কলগুলো কারখানায় নিয়ে যেত। প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ‘পাটপট্টি’ নামে পরিচিত এই ক্রয়কেন্দ্রে এখনো অর্ধশতাধিক পাটের গুদাম রয়েছে।

ব্যবসায়ীদের পাটের ক্রয়বিক্রয় না থাকায় পাটের গুদাম ঘরে ধান, গম পিঁয়াজ, রসুনসহ অন্যান্য ফসলাদি দিয়ে গুদাম চালু রেখেছে বলে জানা যায়।

ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা আরও জানান, নব্বই দশকের শেষের দিক থেকে বেড়ার পাট ক্রয়কেন্দ্রটি স্থবির হতে শুরু করে। সে সময় ইছামতী নদীর উৎসমুখে মুজিব বাঁধ দেওয়ায় ক্রয়কেন্দ্রটিতে জাহাজ ও বড় বড় নৌকার প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে এখানে স্থবির অবস্থার সৃষ্টি হয়। এরপরও গত বছর পর্যন্ত ক্রয়কেন্দ্রটি টিকে ছিল। ২০১৯ সালে একাধিক সরকারি ও বেসরকারি পাটকল এখানে ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করে পাট সংগ্রহ করেছে। কিন্তু সম্প্রতি বিজেএমসি পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় তাঁদের ক্রয়কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এবার বেসরকারি কোনো পাটকলের ক্রয়কেন্দ্র এখানে নেই। ফলে এবার পাটের ভরা মৌসুমে সুনসান নীরব হয়ে আছে ক্রয়কেন্দ্রটি।

বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর সূত্র থেকে জানা যায়, এ বছর বেড়ায় ৩ হাজার ৬১০ হেক্টর ও সাঁথিয়ায় ৮ হাজার ২ শ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করা হয়েছে। গতবার বেড়ায় ২ হাজার ৫৩০ হেক্টর ও সাঁথিয়ায় ৬ হাজার ৫০০ ও জমিতে পাটের আবাদ হয়েছিল। গতবারের চেয়ে এবার পাটের দাম বেশি পেয়েছে কৃষকেরা। তবে আগামী বছর পাটের আবাদ আরও বেশি হবে বলে জানিয়েছেন পাট চাষিরা।

বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত বেড়া ও সাঁথিয়ার পাটের বাজারে ২ হাজার ৩ শত থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা মণ দরে পাট বিক্রি হতে দেখা গেছে। এই দামে পাট বিক্রি করে হাটে যাওয়া-আসার পরিবহন খরচ মিলিয়ে চাষিদের উৎপাদন খরচসহ মোটামুটি কিছুটা লাভবান হচ্ছে কৃষকেরা।

দিনের বেলায়ও এখানে যেন ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। মালবাহি গাড়ী, ভ্যানগাড়ী ও আশেপাশের এলাকার লোকেরা শুধু এখান দিয়ে যাতায়াত করে। যখন সব কয়েকটি পাট ক্রয়কেন্দ্র চালু ছিল তখন ফজরের আজান থেকে শুরু করে রাত গভীর রাত  পর্যন্ত ক্রেতা বিক্রেতাদের ভীর জমে থাকত। সেই ভীর আর এখন কারো চোখে পরে না, সরেজমিনে প্রতিবেদনে গেলে এমনটি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

রুহুল আমিন নামে এক স্থানীয় বলেন, এখানে এক সময় শ্রমিক কর্মচারী ও গোডাউন মালিকদের পদচারণায় মূখর হয়ে থাকত। এখন আর এমন পরিবেশ দেখা যায় না। মাঝে মধ্যে দেখি গোডাউন মালিকরা এসে গোডাউন খুলে একটু ঝাড়– দিয়ে পরিষ্কার করে আবার চলে যায়।

সম্প্রতি পাটপট্টিতে ঘুরে দেখা যায়, পাটপট্টির অর্ধশতাধিক গুদামসহ দোকানগুলো তালা দেয়া অবস্থায় পরে আছে। বেশির ভাগ পাটের গুদামই এখন ফাঁকা পড়ে আছে। আবার কিছু গুদাম অন্য পন্যের গুদাম হিসাবে ভাঁড়া দিচ্ছেন। কিছু গুদামের সামনে গুদাম বিক্রি ও ভাড়া দেয়ার জন্য সাইবোর্ড লাগানো দেখা গেছে। এ ছাড়াও রয়েছে পাট ব্যবসায়ীদের নিজস্ব আরও অনেক পাটের গুদাম।

কয়েকজন শ্রমিক জানান, একসময় বেড়া ক্রয়কেন্দ্রে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করলেও এখন বেড়ায় সাড়ে আট শতাধিক তালিকাভুক্ত শ্রমিক রয়েছেন। গত বছর শ্রমিকের সংখ্যা কমে পাঁচ শতর কাছাকাছিতে নেমে আসে। ক্রয়কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবারের পাট মৌসুমে সব শ্রমিকই বেকার হয়ে পড়েছেন। তাঁদের দিন কাটছে চরম কষ্টে। কেউ কেউ দিন মুজুরের কাজ বা রিকশা-ভ্যান চালানোর পেশা বেছে নিয়েছেন বেঁচে থাকার তাগিদে।

মোঃ ইকরাম হোসেন নামে এক শ্রমিক বলেন, ‘আমরা এই পাটপট্টিতে অনেক শ্রমিকরাই ১৫ থেকে ২০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে কাজ করে আসছি। পাটের কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ জানি না। অথচ হঠাৎ কইরাই আমরা শ্রমিক বেকার হয়া গেলাম। আমরা এখন কি কাজ করে খাব। তিনি আরো জানায়, আমি একটি ব্যাটারী চালিত ভ্যানগাড়ী কিনে কোনমত সংসার চালিয়ে যাচ্ছি। ছেলে মেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে দিন পার করছি স্যার।

শ্রমিক আহমেদ আলী বলেন, আমাদের এখানে এক সময় সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকত, এখন আর এমন দেখা যায় না। এখন শুধু শুনশান নিরবতা বিরাজ করে। এখানকার আয়রোজগার দিয়েই সংসার চালিয়েছি। এখন সবকয়টি ক্রয়কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছি। বর্তমান সরকার যদি এই পাটক্রয়কেন্দ্রটি আবার পুনরায় চালু করার ব্যবস্থা করেন তাহলে আমাদের জন্য ভালই হয়।

কর্মচারী মোস্তফা জামাল বলেন, এক সময় এখানে কর্ম করে বাবার সংসারের হাল ধরেছিলাম, দিনপদ ভালই চলছিল, সম্প্রতি আমাদের এখানে সব পাট ক্রয়কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ায় সংসার অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে চলছে। পরিবারে সব সময় অভাবের কারণে ঝগড়া-বিবাধ লেগেই থাকে।

গুদাম মালিক ওমর আলী ফকির বলেন, ঐতিহ্যবাহী বেড়ার এই পাট ক্রয় কেন্দ্র বন্ধ হওয়ায় ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে গেল। এখানে আমাদের সব চেয়ে বড় পাটের গুদাম ছিল, আমরা বিভিন্ন ক্রয়কেন্দ্র’র কাছে ভাড়া দিতাম। এখন বিজেএমসি পাট ক্রয় করা বন্ধ  করে দিলে আমাদের ব্যবসায় ধস নামে। তাই বর্তমান ওই গুদামটি গমসহ অন্যান্য ফসলের গুদাম বানিয়েছি। সরকারের কাছে আকুল আবেদন জানাই, আমাদের এই পাট ক্রয় যেন পুনরায় চালু করে দিয়ে শ্রমিক কর্মচারিদের রিজিকের সম্বল ফিরিয়ে দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

এ বিষয়ে কয়েকজন ব্যবসায়ীদের সাথে কথা হলে তারা জানান, বেড়া পাট ক্রয়কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপদে পড়েছেন শতাধিক পাট ব্যবসায়ী। এমনিতেই ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে তাঁদের আয়ের পথ। এর ওপর বিজেএমসির একাধিক পাটকলের কাছে ব্যবসায়ীদের পাওনা রয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা। শুধু বেড়ার ব্যবসায়ীরাই বিজেএমসির কাছে ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা পাবেন। বিজেএমসি এই টাকা শোধ না করেই পাটকল বন্ধের ঘোষণা দেওয়ায় তাঁরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

বেড়া বাজারের পাট ব্যবসায়ী শামসুল ইসলাম বলেন, ‘বিজেএমসির কাছে আমার ১৬ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ করে গত ২ বছর বিজেএমসির আমিন জুট মিলসে পাট দিয়েছিলাম। এই টাকা কবে পাব বা আদৌ পাব কি না, তা জানি না। এর মধ্যে আবার পাওনাদারেরা টাকার জন্য চাপ দিচ্ছেন। এখন আমি কী করব তা ভেবেই পাচ্ছি না। আমি ছাড়াও আমার মত আরও অনেকের কোটি কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বিজেএমসির কাছে।

জনতা জুট মিলের সিনিয়র অফিসার নজরুল ইসলাম সেলিম বলেন, এক সময় আমাদের পাটের গোডাউন  ছিল। এখন বিজেএমসি পাটকল বন্ধ করে দেওয়ায় আমরা ওখান থেকে স্থানান্তর হয়ে কাশিনাথপুরে আসছি। তবে ওখানকর সব শ্রমিক কর্মচারী আমাদের এখানে কাজ করছে। এবং তারা কোনমত নিজের সংসার চালিয়ে যাচ্ছে।

বেড়া ও সাঁথিয়ার পাট পরিদর্শক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, আমাদের কাজ আর বিজেএমসির কাজে অনেক পার্থক্য রয়েছে। আমরা পাটের মোড়ক ঠিকমত ব্যবহার করছে কিনা সেই দিকে খেয়াল রাখি বা মানুষকে সচেতন করি। আর এটা একান্তই বিজেএমসির কাজ বলে আমি মনে করি, তারা যদি পুনরায় পাটকলগুলো চালু করে তাহলে ভাল হবে। পুরনায় পাটকলগুলো চালু করে এখানকার ক্রয়কেন্দ্র আগের মত ফিরিয়ে দিলে এখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা বেগতিক হতো বলে আমি মনে করি।

আগামীনিউজ/মিথুন