চালের দাম বৃদ্ধি

নিজস্ব প্রতিবেদক অক্টোবর ৩, ২০২০, ১০:২৩ এএম
ছবি সংগৃহীত

ঢাকাঃ বাজারে চাল নিয়ে আবার চালবাজি শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহে যে মোটা চালের দর ছিল ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা ২ হাজার ৩৫০ টাকা। গতকাল শুক্রবার (০২অক্টোম্বর) সেই চাল বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৪০০ টাকা। অর্থাৎ এক সপ্তাহের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি দাম বেড়েছে ৫০ টাকা। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে মিলগেটে দর নির্ধারণ করে দিলেও খুচরা বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি।

গতকাল শুক্রবার (০২সেপ্টেম্বর) রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সবধরনের চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় মোটা চালের চাহিদাও বেড়েছে। সেই সুযোগে পাইকারি ও খুচরা বাজারে মোটা চালের দামও বাড়ানো হয়েছে। কোথাও কোথাও এর সংকট দেখা দিয়েছে। এর জন্য মিলার এবং আড়তদাররা পরস্পরকে দোষারোপ করছেন। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ও পরস্পর একমত হতে পারেনি।

খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, মিল গেটে দর নির্ধারণ করে দেয়ার এখতিয়ার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। এটি করা হয়েছে। কিন্তু পাইকারি ও খুচরা বাজারে দর নির্ধারণ করে দেবে কৃষি মন্ত্রণালয়। তারা যদি এটি না করে, তাহলে বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে না। কৃষি মন্ত্রণালয় বলেছে, আগামী সপ্তাহের প্রথম দিকেই পাইকারি ও খুচরা বাজারে চালের দর নির্ধারণ করে দেয়া হবে।

মিলারদের অভিযোগ, চালের বাজারে এই অস্থিরতার জন্য আড়তদাররাই দায়ী। আড়তদাররা বলছেন, দর নির্ধারণের বৈঠকে মিলাররা সম্মতি দিলেও নির্ধারিত দরে তারা চাল বিক্রি করছেন না। ফলে পাইকারি বাজারে বা খুচরা বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। মিলাররা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দরে চালের পাইকারি ব্যবসায়ী বা আড়তদাররা চাল কিনছেন না। তাদের মজুদ করা চালই বেশি দামে বিক্রি করছেন, ফলে খুচরা বাজারে চালের দরে স্থিতিশীলতা আসেনি।

একাধিক পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, মিল মালিকরা বৈরী আবহাওয়ায় ধান প্রক্রিয়াজাত করে চাল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কথা বলছেন। আমন মৌসুমের আগে চালের ঘাটতির অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। যদিও এখন বেশিরভাগ অটো রাইস মিলে চাল উৎপাদনে আবহাওয়ার কোনো প্রভাব নেই। এ ছাড়া বোরো ও আউশ ধানের বেশ সরবরাহ আছে। এ অবস্থায় দাম বৃদ্ধির যৌক্তিক কারণ নেই।

সরকারের দাম বেঁধে দেয়া পরেও রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে গত তিন দিনের ব্যবধানে খুচরায় সব ধরনের চাল কিনতে কেজিতে গড়ে পাঁচ টাকা বেশি গুনছেন ক্রেতারা। মাঝারি মানের চাল লতা ও বিআর-২৮ এখন ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত সপ্তাহে ছিল ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা। বাজারে মোটা গুটি ও স্বর্ণা চাল তেমন পাওয়া যাচ্ছে না।

দু-একটি দোকানে বিক্রি হলেও তা এখন একই হারে বেড়ে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। সরু চাল মিনিকেটের কেজি ৫৮ থেকে ৬০ টাকায় পৌঁছেছে, যা ছিল ৫২ থেকে ৫৫ টাকা। মানভেদে নাজিরশাইল চাল বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে। যে মানের নাজিরশাইল আগে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি ছিল, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। মোটা চালের দাম বেড়ে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা হয়েছে।

বনশ্রী এ ব্লকের মামুন রাইচ এজেন্সির বিক্রেতা মামুন উদ্দিন সরকার মানবকণ্ঠকে বলেন, করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের শুরুতে চালের দাম কিছুটা বেড়েছিল। এর পর মৌসুমী চালের সরবরাহ বাড়তে থাকায় দাম আবার কমে আসে। এখন আবার মিল মালিকরা দাম বাড়াচ্ছেন।

তিনি আরো জানান, চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় মোটা চালের কদর বেড়েছে। এ জন্য গত তিন দিন ধরে পাইকারি আড়তে অর্ডার দিয়েও মোটা চাল মিলছে না।

রাজধানীর কারওয়ানবাজার, রামপুরা, মেরাদিয়া, শাহজাহানপুর, মালিবাগ বাজার, খিলগাঁও চৌধুরীপাড়া, শান্তিনগর, মেরুল বাড্ডা, উলন, নতুন বাজার, খিলক্ষেতসহ একাধিক বাজারে দেখা গেছে চালের দাম নিয়ে নানা রকম নৈরাজ্য। সরবরাহ সন্তোষজনক থাকলেও দাম ঊর্ধ্বমুখী। খুচরা বাজারে সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে এ নিয়ে চলছে নানা অসন্তোষ।

দাম বাড়ার যৌক্তিক কারণ নেই: খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোসাম্মৎ নাজমানারা খানম বলেন, এখন চালের দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। বোরো ও আউশ মৌসুমের পর্যাপ্ত ধান ও চাল কৃষক ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে আছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এবার দেশে চাল উৎপাদন বেড়েছে। বাজারে ধান ও চালের ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। হঠাৎ করে চালের দাম কেজিতে পাঁচ টাকা বাড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

তিনি আরো বলেন, অসাধু চক্র চালের বাজার অস্থির করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এ জন্য বাজার অভিযান জোরদার করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসকদের এরই মধ্যে চিঠি দেয়া হয়েছে। বাজারে সংকট সৃষ্টি এবং চালের বাজার অস্থির করার অপকৌশল নিয়ে দাম বাড়ালে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

খাদ্য সচিব বলেন, বাজার স্বাভাবিক রাখতে ৫০ লাখ পরিবারের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় দেড় লাখ টন চাল দেয়া শুরু হয়েছে। খোলা বাজারে বিক্রি বাড়ানো হয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়বে। সরকারের হাতে ১৪ লাখ ১৮ হাজার টনের বেশি চাল মজুদ আছে।

এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, ‘কিছু ব্যবসায়ী বাড়তি মজুদ করতে পারেন। এসব জায়গায় অভিযান জোরদার করা প্রয়োজন। ওই চাল বাজারে না এলে দাম ধরে রাখা কঠিন হবে। সীমিত আকারের হলেও আমদানি চাল এলে বাজারে ইতিবাচক চাপ তৈরি হবে।’

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্য সচিব গোলাম রহমান বলেন, ‘অসাধু চক্র সব সময় বাজার থেকে ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করে। এদের আরো কঠোরভাবে দমন করতে হবে। এবার সরকারি চাল সংগ্রহ কম হয়েছে। গুদামে অন্য বছরের চেয়ে মজুদ কম আছে। সে কারণে ব্যবসায়ীরা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। তারা অতি মুনাফা করার সুযোগ নিচ্ছেন।

হুঁশিয়ারিতেও কাজ হচ্ছে না: নির্ধারিত দরের বেশি দামে চাল বিক্রি করলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রীর কড়া হুঁশিয়ারির পরেও বাজারে এর কোনো প্রতিফলন নেই। মোটা চালের সংকটের দোহাই দিয়ে সব ধরনের সরু চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৪ থেকে ৬ টাকা। ৫৬ টাকা কেজি দরের মিনিকেট বা নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬২ টাকা কেজি দরে। পর্যাপ্ত উৎপাদন, যথেষ্ট মজুদ এবং সরবরাহ ব্যবস্থায় কোনো ধরনের ত্রুটি না থাকার পরেও এই সময় চালের এই মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি সরকারকে বিব্রত করেছে।

কুষ্টিয়ার এক মিল মালিক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা সরকার নির্ধারিত দরে চাল বিক্রির জন্য বসে থাকলেও আড়তদাররা এই চাল কিনছেন না। তারা গত দুই দিনে সরকার নির্ধারিত দরে চাল কেনার জন্য কোনো অর্ডার করেনি। কারণ এই দাম কিনলে তো কম দামে বেচতে হবে। এই কারণে তারা কিনছেন না। বেশি মুনাফার আশায় তারা যে শত শত টন চাল মজুদ করেছে, সেই চালই বিক্রি করছেন। অথচ আমাদের দায়ী করছেন তারা। যা অযৌক্তিক।’

চালের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে পাইকারি ও খুচরা বাজারে দর নির্ধারণ করে দেবেন কি না- জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহম্মদ নাসিরুজ্জামান জানিয়েছেন, ‘আমরা আলাপ আলোচনা শুরু করেছি। বিষয়টি নিয়ে কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছি। আশা করছি রবিবার বা সোমবারের মধ্যে এটি আমরা চ‚ড়ান্ত করতে পারব।

মিলগেটে দরদাম: দাম বৃদ্ধির লাগাম টানতে গত ২৯ সেপ্টেম্বর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে চালের দাম নির্ধারণ করে দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। মিলগেটে প্রতিকেজি সরু মিনিকেট চাল ৫১ টাকা ৫০ পয়সা ও মোটা চাল ৪৫ টাকায় বিক্রির নির্দেশনা দেয়া হয়। আর সর্বোচ্চ ৫৩ টাকায় চাল বিক্রি করতে পারবেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। তবে শুক্রবার রাজধানীর আড়ত ও খুচরা বাজারে দেখা গেছে আগের বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের চাল। কুষ্টিয়া ও নাটোরের মিলগেটেও একই চিত্র দেখা গেছে।

গত মঙ্গলবারের সভায় খাদ্যমন্ত্রী বলেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে মিনিকেট চাল আগের দামে বিক্রি করতে হবে। পাইকারি বাজারে ৫১ থেকে ৫৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সেই হিসাবে প্রতি বস্তা মিনিকেট চালের দাম সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫৭৫ টাকা। আর ২৮ নম্বর বা মাঝারি মানের চাল প্রতি বস্তা ২ হাজার ১৫০ থেকে ২ হাজার ২৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাইকারিতে প্রতি কেজি চাল ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা। এর ব্যত্যয় হলে ১০ দিনের মধ্যে সরু চাল আমদানি করা হবে।

আগামীনিউজ/জেহিন