করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আইসক্রিম শিল্প

ডেস্ক রিপোর্ট সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২০, ০১:১৬ পিএম
ফাইল ছবি

ঢাকাঃ দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমবর্ধমান শিল্প হিসেবে বিকশিত হচ্ছিল আইসক্রিম শিল্প। প্রতি বছরই ১৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছিল এ খাতে। কিন্তু করোনার ধাক্কায় প্রবৃদ্ধি তো দূরের কথা, আইসক্রিম বিক্রির হার প্রায় শূন্যে এসে ঠেকেছে। ফলে করোনার প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে আইসক্রিম শিল্প। কিন্তু তুলনামূলক ছোট আকারের শিল্প হওয়ার কারণে নীতিনির্ধারকদের সুনজরে আসেনি এ খাতের সংকট। সরকারের সহযোগিতা না পেলে এ খাতের বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি খাতটির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

এ খাতের প্রতিষ্ঠানের মতে, আইসক্রিমের ব্যবসা হচ্ছে মৌসুমভিত্তিক। এর মধ্যে এপ্রিল, মে ও জুন এ তিন মাস আইসক্রিমের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। এর বাইরে আইসক্রিম বেশি বিক্রি হয় মার্চ, জুলাই ও আগস্টে। ফেব্রুয়ারি, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর এ চার মাস অফ-পিক মৌসুম। আর ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে শীতকালে আইসক্রিম তেমন একটা বিক্রি হয় না। ৭-১৬ বছর বয়সী ভোক্তাদের মধ্যে আইসক্রিম বেশি জনপ্রিয়। তাছাড়া পুরুষদের চেয়ে নারীরা তুলনামূলক বেশি আইসক্রিম খেয়ে থাকে। ঘুরতে যাওয়া, সিনেমা দেখা, আড্ডার সময় অর্থাৎ ঘরের বাইরে থাকার সময়ে মানুষ বেশি আইসক্রিম খায়। অঞ্চল হিসেবে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি আইসক্রিম বিক্রি হয়।

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর আইসক্রিমের নেতিবাচক প্রভাবসংক্রান্ত খবর ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে আইসক্রিম খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়। যদিও এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পাওয়া যায়নি। দেশে করোনার সংক্রমণ শুরুর পর মার্চ থেকেই আইসক্রিমের বিক্রি কমতে থাকে। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাস পর্যন্ত সাধারণ ছুটির সময়ে স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, শপিং মল, বিনোদন কেন্দ্র সবকিছুই বন্ধ ছিল। জুন থেকে ধীরে ধীরে সীমিত পরিসরে অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালুর অনুমতি দেয়া হয়। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো পর্যন্ত বন্ধই রয়েছে। ফলে আইসক্রিমের পিক মৌসুম অর্থাৎ এপ্রিল, মে ও জুনে একেবারেই ব্যবসা হয়নি। এ সময়ে আইসক্রিম উৎপাদনও বন্ধ ছিল। ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে জুলাই থেকে সীমিত পরিসরে আইসক্রিম উৎপাদন শুরু হয়। সামনে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আইসক্রিমের অফ-পিক মৌসুম। এতে করোনা ও অফ-পিক মিলিয়ে এ বছর দেশের আইসক্রিম কোম্পানিগুলো মাত্র ৩০ শতাংশের মতো ব্যবসা করতে পেরেছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতির পাশাপাশি সামনের বছরের প্রথম প্রান্তিকে ভ্যাকসিন চলে এলে ব্যবসায় গতি

আসার প্রত্যাশা করছে খাতসংশ্লিষ্টরা।

ইউরোমনিটরের তথ্যমতে, বৈশ্বিক জিডিপির দশমিক শূন্য ৫৩ শতাংশ আসে আইসক্রিম খাত থেকে। আর বাংলাদেশে জিডিপিতে এ খাতের অবদান দশমিক ৬৪ শতাংশ। গত তিন বছরে আইসক্রিম শিল্পে প্রবৃদ্ধির হার ছিল সবচেয়ে বেশি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও খাতসংশ্লিষ্টদের তথ্যানুসারে বর্তমানে দেশে ব্র্যান্ডের আইসক্রিমের বাজার রয়েছে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার। এর বাইরে নন-ব্র্যান্ডেড আইসক্রিমেরও বড় বাজার রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট, ফাস্টফুড, হোটেলকেন্দ্রিক আমদানীকৃত আইসক্রিমের বাজারও খুব একটা ছোট নয়। ফলে সব মিলিয়ে আইসক্রিমের বাজারের আকার ২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

আইসক্রিমের বাজারে শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড হচ্ছে আব্দুল মোনেম লিমিটেডের ইগলু। এক দশক আগে দেশের আইসক্রিমের বাজারের ৭০ শতাংশ ছিল ইগলুর দখলে। কিন্তু প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বাজার হারিয়ে ২০১৫ সালে এর মার্কেট শেয়ার ৩৬ শতাংশে নেমে আসে। তবে তিন বছর ধরেই উচ্চপ্রবৃদ্ধির কারণে বর্তমানে আইসক্রিমের বাজারের ৪৭ শতাংশ ইগলুর দখলে।

আইসক্রিম শিল্পে করোনার প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে ইগলুর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জিএম কামরুল হাসান বলেন, করোনার কারণে আইসক্রিম শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঠান্ডাজাতীয় খাবার বিশেষ করে আইসক্রিমের সঙ্গে করোনাকে মিলিয়ে অনেক ভিত্তিহীন ও অবৈজ্ঞানিক প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছে। এতে মানুষের আইসক্রিম খাওয়া নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ফলে বর্তমানে আইসক্রিমের বিক্রি ৩০ শতাংশে নেমে গেছে। এক-দেড় মাস ধরে কিছু আইসক্রিম বিক্রি হচ্ছে, তবে তা যৎসামান্য। বিশ্বের অনেক দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিচ্ছে। আমাদের এখানে এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত না হলেও একসময় খুলে দিতেই হবে। আইসক্রিম ভোক্তার ৬০ শতাংশই হলো বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে ও করোনার ভ্যাকসিন চলে এলে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকে আইসক্রিমের বাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আমি আশাবাদী।

আইসক্রিমের বাজারে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা আইসক্রিম ইন্ডাস্ট্রিজের ব্র্যান্ড পোলার। বর্তমানে পোলারের মার্কেট শেয়ার ৩৭ শতাংশ। ১৯৮৬ সাল থেকে পরবর্তী এক দশক দেশের আইসক্রিমের বাজারে শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড ছিল পোলার।

গোল্ডেন হার্ভেস্ট আইসক্রিমের ব্র্যান্ড ব্লুপের দখলে রয়েছে ৯ শতাংশ বাজার। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানটির ২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বছরটিতে তারা ১২০ কোটি টাকার আইসক্রিম বিক্রি করে, যেখানে এর আগের বছরে বিক্রি হয়েছিল ৮৭ কোটি টাকা।

নেতিবাচক প্রচারণা আমলে না নিয়ে মানুষকে আইসক্রিম খাওয়ার আহ্বান জানিয়ে গোল্ডেন হার্ভেস্ট আইসক্রিম ও ফ্রোজেন ফুডের সিইও এসএম মোমতাজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, করোনার কারণে আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। সাধারণ ছুটির সময়ে কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে। জুলাই থেকে কারখানা চালু করা হলেও চাহিদা না থাকায় সীমিত পরিসরে উৎপাদন চালাতে হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ শ্রমিক দিয়ে কারখানায় কাজ চলছে। আইসক্রিমের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব কাঁচামালই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এ বছরের বাজার চাহিদার কথা চিন্তা করে করোনার আগেই অনেক কাঁচামাল আমদানি করা হয়েছিল। এছাড়া সে সময় যেসব এলসি খোলা হয়, সেগুলোর চালান এখন আসছে। কিন্তু চাহিদা না থাকায় আমরা এসব কাঁচামাল কাজে লাগাতে পারছি না। ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় অনেক কাঁচামাল ফেলে দিতে হচ্ছে। আমদানিনির্ভরতা কমাতে নিজেরাই ডেইরি ফার্ম স্থাপন করে সেখানে উৎপাদিত দুধ আইসক্রিমে ব্যবহার করছি আমরা। তবে বর্তমানে আইসক্রিমের চাহিদা না থাকায় দুধ নষ্ট হচ্ছে। ছোট হলেও সম্ভাবনাময় ও ক্রমবর্ধমান খাত হিসেবে এ শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের নীতি সহায়তা প্রয়োজন।

আইসক্রিমের বাজারে কোয়ালিটির দখলে রয়েছে ৯ শতাংশ। তুলনামূলক নতুন ব্র্যান্ড লাভেলোর দখলে রয়েছে আইসক্রিমের বাজারের ৭ শতাংশ। বাজারে কাজী ফার্মস বেলিসিমো ব্র্যান্ডের আইসক্রিম বিক্রি করে। এর বাইরে গুলশান, বনানী, বারিধারা ও ধানমন্ডিকেন্দ্রিক বেশকিছু বিদেশী ব্র্যান্ডের আইসক্রিমের আউটলেট রয়েছে। এছাড়া নন-ব্র্যান্ড ও খোলা আইসক্রিমের বাজারও বেশ বড়।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে আইসক্রিম শিল্পে দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। এর বড় অংশই ব্যাংকঋণ। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পের মধ্যে আইসক্রিম খাত না থাকায় সরকার ঘোষিত প্রণোদনার সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার আইসক্রিম খাতের ব্যবসায়ীদের স্বতন্ত্র কোনো সংগঠন না থাকায় তারা সেভাবে নিজেদের দাবিদাওয়া তুলে ধরতে পারছেন না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থে তারা সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করানোর উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানা গেছে। ডিস্ট্রিবিউটর, সাপ্লায়ার মিলিয়ে এ খাতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষ সংশ্লিষ্ট রয়েছে। তাছাড়া আইসক্রিমের বক্স ও প্যাকেজিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠান। করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাত হিসেবে কাঁচামাল ও লজিস্টিকসের ওপর শুল্ক কমানোর পাশাপাশি আয়কর ছাড় চাইছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। স্বল্পমূল্যে দুধ প্রাপ্তির জন্য ডেইরি ফার্মগুলোকে ভর্তুকি দেয়া ও সুদের হার কমানোরও দাবি জানিয়েছেন তারা। সুত্র; বণিক বার্তা

আগামীনিউজ/আশা