রূপগঞ্জে আইন শৃঙ্খলার অবনতিঃ বেড়েছে চুরি ডাকাতি ছিনতাই

নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জ এপ্রিল ২৬, ২০২১, ০১:২৩ পিএম

রূপগঞ্জঃ রূপগঞ্জে লকডাউনে ও এর পরে আশঙ্কাজনকহারে চুরি ডাকাতি ছিনতাই বেড়ে গেছে। সড়ক মহাসড়কে, হাটে বাজারে, বাড়ীতে গাড়ীকে সবখানেই আতঙ্ক উৎ পেতে আছে। কখন যে কার সর্বশ^ লুটে নিচ্ছে কেউ টেরও পাচ্ছে না।

প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব ঘটনা ঘটলেও অপরাধীদের কিছুতেই আটকাতে পারছে না প্রশাসন। আর এ সুযোগে অপরাধীরা দিনকে দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠছে। একই রাতে উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের নগরপাড়া এলাকায় ৫ টি গরু চুরি হয়েছে। গৃহস্থ্যের সর্বশ^ চুরি করে নিলেও কেউ জানতেও পারলেন না কে বা কারা এমন অপকর্ম করেছে। উত্তরপাড়া এলাকার জুলহাস মিয়া বলেন, মামাগো আমার ২ টা গরু চুরি করে নিয়ে গেছে। একটু টেরও পেলাম না। আগামী কোরবানীর জন্য গরু ২ টা তৈরি করছিলাম। আমারে একেবারে ফকির বানাইয়া দিল গো মামা। ধার দেনা করে গরু কিনেছিলাম। কোরবানীর সময় বিক্রি করে দেনা পরিশোধ করার কথা ছিল। এখন কিভাবে আমি ধার পরিশোধ করমু একমাত্র আল্লাহ- ই ভাল জানেন। বড়ালু এলাকার নাম প্রকাশে একজন নারী বলেন, বাজান সন্ধ্যা রাতে রান্না করার সময় আমার কানের জিনিসটা একটা টানে নিয়া গেল গো বাজান। কিছুই করতে পারলাম না। আমার অনেক স্বাদের জিনিস গো বাজান।

বাগবাড়ী এলাকার আলমগীর মিয়া বলেন, ভাই কামলা খাইটা একটা গরু কিনছিলাম। অনেক কষ্ট কইরা গরুটা বড় করলাম। হঠাৎ করইরা চোরে লইয়া গেল গা। টেরও পাইলাম না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলাইয়া, অনেক কষ্টের কামাই গো ভাই। আল্লাহ এদের বিচার করে না কেন?? ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে চুরি ডাকাতি ছিনতাই ও তত বাড়ছে। সড়ক মহাসড়কগুলোতে ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। মানুষকে খুন জখম করতেও দ্বিধা করছে না। প্রশাসন তাদের কিছুই করতে পারছে না। উপজেলার ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও এশিয়ান হাইওয়ে রোড যেন ছিনতাইকারীদের নিরাপদ ট্রানজিট রুট। প্রতিনিয়তই এখানে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে থাকে। অনেকেই সর্বস্ব হারান। কেউবা আবার প্রাণ প্রদীপও হারান এ পথে। এত কিছুরই পরও দেখার কেউ নেই যেন। মহাসড়কে এখন মহাগেঞ্জাম চলছে। মৃত্যু ফাঁদে পরিনত হয়েছে মহাসড়ক।

থানা পুলিশ ও পত্রিকা সুত্রে জানা যায়, ২৪ এপ্রিল দিবাগত রাতে এশিয়ান হাইওয়েতে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। গাজীপুর-চট্টগ্রাম এশিয়ান হাইওয়ে সড়কের রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইলে ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়ে আহত হন এসিআই কোম্পানীর কভার ভ্যান চালক হাসান(৫০)। শুক্রবার দিবাগত ভোর রাতে শনিবার ভোরে উপজেলার গোলাকান্দাইল দক্ষিণপাড়া ব্রিজের পাশে এ ঘটনা ঘটে।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ফেনী থেকে এসিআই কম্পানীর মালবাহী একটি কভার ভ্যান (ঢাকা মেট্টো-ট ২২-২৬৩৬) নিয়ে সিরাজগঞ্জের যাওয়ার পথে গাজীপুর-চট্টগ্রাম এশিয়ান হাইওয়ে সড়কে রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইল দক্ষিণপাড়া ব্রিজের পাশে একটি মাটির ট্রাক রাস্তা বেরিকেড দিয়ে কভার ভ্যানের গতিরোধ করে ছিনতাইকারীরা। এসময় ৪-৫ ছিনতাইকারী কভার ভ্যানে উঠে চালক হাসানকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে সঙ্গে থাকা ১৮ হাজার টাকা,২ টি মোবাইল সেট নিয়ে যায়। পরে ওই কভার ভ্যানের হেলপার মামুন মোল্লা তাকে উদ্ধার করে আল রাফি হাসপাতালে নিয়ে যায়। আহত হাসান যশোর জেলার কোতয়ালী উপজেলার মৃত মৈনুদ্দিন খন্দকারের ছেলে।

এছাড়াও একই রাস্তায় গত মঙ্গলবার (১৩এপ্রিল) রাত ১২ টার দিকে গোলাকান্দাইল আল-রাফি হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্স চালক ফারুক আহম্মেদ ফয়সাল হাসপাতালে এ্যাম্বুলেন্স পার্কিং করে নিজের মোটরসাইকেল (ঢাকা মেট্রো ল-৪৩-৬৯৮৭) যোগে বাড়ি ফেরার পথে উপজেলার গোলাকান্দাইল ব্রিজের সামনে পাকা রাস্তায় পিছন দিক থেকে একটি নীল রংয়ের মোটর সাইকেলযোগে কাউছার মিয়া (২৬) নামে এক ছিনতাইকারী অজ্ঞাত আরো দুইজন ছিনতাইকারী নিয়ে তার পথরোধ করে এবং তাকে এলোপাথারীভাবে মারপিট করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে ধারালো ছোরা বের করে প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে বলে যা আছে সব দে।

ছিনতাইকারী কাউছার হলেন উপজেলার গোলাকান্দাইল পূর্বপাড়া এলাকার হারুন মিয়ার ছেলে। এসময় ছিনতাইকারীরা ফারুক আহম্মেদ ফয়সালের কাছ থেকে নগদ টাকাসহ মোটর সাইকেলের যাবতীয় কাগজপত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গলায় থাকা স্বর্ণের চেইন ছিনতাই করে এবং ধারালো ছোরা দিয়ে তার হাতে গুরুতর জখম করে। তার ডাক-চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে ছিনতাইকারীরা পালিয়ে যায়। পরে আশপাশের লোকজনের সহযোগিতায় উদ্ধার হয়ে রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। এরপুর্বে ভুলতা ফ্লাইওভারের নীচে এক ব্যবসায়ীর ৭০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। এছাড়াও রূপগঞ্জে কিশোর গ্যাং আরো বেপরোয়া। তুচ্ছ ঘটনায় শুরু হয় হুন্ডার মহড়া আর অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি।

রূপগঞ্জের আপামর জনগন এ নিয়ে আতঙ্কিত। স্থানীয় জনগন জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কাছে এর প্রতিকার চায়। মাদকসেবীদের দাবিকৃত অটোরিক্সা না দেয়ায় ৩ এপ্রিল রাতে সাজ্জাদ হোসেন (২০) নামে একজনকে শ^াষরোধ করে হত্যা করে তারই বন্ধুরা। আজও বিচার চেয়ে মানুষের ধারে ধারে ঘুরছেন অসহায় মা। ২৪ এপ্রিল ভোর রাতে চাকরিচ্যুত ও বলৎকারের মিথ্যা অপমান সইতে না পেরে আব্দুর রহমান (৩০) নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষক আত্মহত্যা করেন। পুলিশের এক তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, লিয়াং হো রোং (৪০) নামে এক চায়না ইঞ্জিনিয়ারকে শ^াস রোধ করে হত্যা করে র্দুবৃত্তরা। ১৩ মার্চ তারাব এলাকার জো জো ইন্ডাট্রি থেকে তার জুলন্ত লাশ উদ্ধার করে থানা পুলিশ। ৮ এপ্রিল সকালে র‌্যাবের এক অভিযানে ৯ ড্রাম ভর্তি ১২৬০ লিটার তেলসহ দুই তেল চোরকে আটক করে। ১২ এপ্রিল রাতে ওয়াসিম (৩৫) ও ফারুক (৪০) নামে দুই অটো চোরকে আটক করে পুলিশ।

৩ এপ্রিল ভোর রাতে উপজেলার চনপাড়া এলাকা থেকে যুবতীকে ধর্ষণের দায়ে দুই আসামীকে গ্রেফতার করে থানা পুলিশ। ৬ এপ্রিল মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার পোনাব এলাকার সাত্তার কোম্পানীর ইটভাটা সংলগ্ন একতলা পরিত্যাক্ত ভবন থেকে এক শ্রমিকের গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২ এপ্রিল ২০ হাজার টাকা চাঁদা না দেয়ায় হৃদয় ফরাজী নামে এক বলগেট শ্রমিককে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। আওয়ামীলীগ নেতাকে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা।

১ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে উপজেলার মাসুমাবাদ দীঘির পার এলাকা থেকে পাচাইখার আব্দুল করিমের ছেলে সুমন মিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৯ মার্চ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে এক সড়ক দৃর্ঘটনায় ১৫ জন আহত হন। একই ঘটনায় নরসিংদীর রায়পুরা থানার শিপপুর এলাকার ছমির উদ্দিনের ছেলে আকাশ মিয়া নিহত হয়। ২৯ মার্চ এশিয়ান হাইওয়ে সড়কে আরো একটি দুর্ঘটনায় ১ জন নিহত হয়। একই দিনে জমি নিয়ে বিরুদের কারনে সংঘর্ষে ১৫ জন আহত হন। ভোক্তভুগীরা রূপগঞ্জের সড়ক মহাসড়কে, হাটবাজারে, রাস্তায় গলিতে সিসি ক্যামেরা লাগানোর দাবি জানিয়েছেন।

এছাড়াও সর্বত্র পুলিশ টহল জোড়দারের দাবিও জানান সাধারণ মানুষ। বেশ কিছু দিন যাবৎ রূপগরেঞ্জ অদৃশ্য কারণে কোনো ওসিই দীর্ঘদিন স্থায়িত্ব পাচ্ছেন না। ওসি মাহমুদুল হাসান বদলি হওয়ার পর থেকে এ অবস্থা বিরাজ করছে। ওসি যায় ওসি আসে কিন্তু রূপগঞ্জের আইনশৃঙ্খলার কোনো উন্নতি হয় না। সর্বশেষ ওসি মুহসিনুল কাদের বদলি হওয়ার পর অনেক দিন অতিবাহিত হলেও নতুন কোনো ওসি এখনও থানায় যোগদান করেননি। সেই থেকে দায়িত্ব পালন করছেন তদন্ত ওসি জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, আমাদের লোকবল সঙ্কট রয়েছে। সর্বত্র টহল চালানো সম্ভব নয়।

পূর্বাচল, এশিয়ান হাইওয়ে, ঢাকা সিলেট মহাসড়কে আমাদের নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি টহল টিমও কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় আসামীও ধরছে। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কিশোরগ্যাংয়ের ব্যাপারেও আমরা সতর্কদৃষ্টি রাখছি। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ নুশরাত জাহান বলেন, আমাদের লোকবলের সঙ্কট রয়েঠে। তারপরও আমারা নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছি। কোনো অপরাধীকে ছাড় দিচ্ছি না। দিবও না। মহামারী করোনায় ও লকডাউনের কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটু শিথিল ছিল। এখন আবার পুরাদমে অভিযান চলবে।

ঈদ উপলক্ষ্যে হাটবাজার গুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। আমারা বেজালকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছি। জেল জরিমানা করছি। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করছি। মাদকসেবী ও বিক্রেতাদের বিরুদ্ধেও অভিযান চলছে। তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে মামলা, জেল জরিমানা করা হচ্ছে। মহসড়কগুলোতেও টহল ব্যবস্থা জোরদার করেছি।

আগামীনিউজ/জনী