ইথানল ও মিথানলে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল

নিজস্ব প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২১, ০৫:৫২ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকাঃ অ্যালকোহলে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত ইথানল ও মিথানল। আর এটিই পান করে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ছেন মানুষ। গত কয়েকদিনে ইথানল ও মিথানল মেশানো অ্যালকোহল পানে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। গত থার্টি ফার্স্ট নাইট থেকে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধশত পেরিয়েছে। শুধু বগুড়াতেই মারা গেছে ১৭ জন।

সম্প্রতি মদের সংকটের সুযোগে ভেজাল মদ ব্যবসায়ীরা অ্যালকোহল হিসেবে ইথানলের সঙ্গে মিথানল ও চোলাই মদ ব্যবহার করছেন, যা মানবদেহের জন্য শতভাগ ক্ষতিকর। এটি পানে ২ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু নিশ্চিত। শরীরের ত্বকে ইথানল ব্যবহার ও শরীরের ভেতর ইথানল ব্যবহার করা এক কথা নয়। এটি বারবার ব্যবহারের ফলে ব্রেইনে গিয়ে তীব্র নেশার সৃষ্টি করে। অন্যদিকে এটি ফুসফুসে গিয়ে ফুসফুসকে ধীরে ধীরে ড্যামেজ করে দেয়। মিথানল মূলত কাঠ বার্নিশে ও বিভিন্ন শিল্পকারখানায় ব্যবহার করা হয়। কোনোভাবেই পানের উপযোগী নয়। ভেজাল মদ ব্যবসায়ীরা ইথানলের সঙ্গে মিথানল এবং চোলাই মদ ব্যবহার করে বিদেশি মদের বোতলে ভরে বিক্রি করছেন, যা পান করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন আসক্তরা। 

সম্প্রতি মদ পানে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার ২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। একইভাবে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ জন এবং বগুড়ায় ১৭ জন মারা গেছেন। সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, মদের বিষক্রিয়ায় তাদের মৃত্যু হয়েছে।

শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞাপনী সংস্থার ২ জনের মৃত্যু: গাজীপুরের সারাহ রিসোর্টে বেড়াতে যাওয়া ২টি বেসরকারি শীর্ষ পর্যায়ের বিজ্ঞাপনী সংস্থার একদল কর্মীর বেশ কয়েকজন মদ পানে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ওই রিসোর্টে একই মালিকানাধীন ২টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪০ জন সদস্য গত শুক্রবার বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে মদ পানের পর অন্তত ১০ জন অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাদের রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের মধ্যে ২ জন হাসপাতালে মারা গেছেন, আর ২ জন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অন্যরাও বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ শিক্ষার্থী মৃত্যু: একইভাবে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মদ পানের পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র ও একজন ছাত্রী। চিকিৎসকরা মনে করছেন, মদের বিষক্রিয়ায় তারা মারা গেছেন। মৃত ওই ছাত্রীর বাবা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে ধর্ষণ মামলা দায়ের করেছেন। যেখানে ওই ছাত্রীর বন্ধু রায়হানসহ ৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।

সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আ ম সেলিম রেজা গণমাধ্যমকে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েটির শরীরের কোথাও আঘাত বা জখমের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তার শরীরের গোপন স্থানেও অস্বাভাবিক চিহ্ন মেলেনি। মৃত্যুর আগে তার ওপর জোর প্রয়োগ করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। ইতোমধ্যে তার ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে কি না সেটি জানতে তার মরদেহ থেকে ভিসেরা আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া তার গোপন অঙ্গের আলামত সংগ্রহ করে ডিএনএ টেস্টের জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু হতে পারে।

বগুড়ায় মদের বিষক্রিয়ায় ১৭ জনের মৃত্যু: বগুড়া শহরের তিনমাথা রেলগেট এলাকার খান হোমিও হল থেকে গত সোমবার বিকেলে বিষাক্ত অ্যালকোহল (স্প্রিট/ইথানল) পান করেন বলে জানিয়েছেন পুলিশ ও এলাকাবাসী। মৃতরা হলেন-ঢাকাগামী কোচের বগুড়ার তুহিন পরিবহন কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতা দিলবর রহমান দিলীপ, চারমাথা ভবের বাজার এলাকার মোটর শ্রমিক আলমগীর হোসেন, পালশা এলাকার রাজমিস্ত্রি রমজান আলী, সুইপার সুমন রবিদাস, ভ্যানচালক সাজু, বগুড়া মোটরসের কর্মচারী পলাশ, প্রেমনাথ রবিদাস (৬০), শহরতলির ফাঁপোড়ের রিকশাচালক জুলফিকার (৫২) ও নিশিন্দারা ধমকপাড়ার আলমগীর (৪০)।

পুলিশ এবং তাদের স্বজনরা জানান, তিনমাথা রেলগেট এলাকায় খান হোমিও হল থেকে তারা বিষাক্ত অ্যালকোহল পান করেছিলেন। তবে নিহতদের স্বজনরা কেউ কেউ অ্যালকোহল পানের কথা স্বীকার করলেও সাংবাদিকদের সামনে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে দাবি করেন। ঘটনার পর থেকেই খান হোমিও হলের মালিক শাহিনুর রহমান শাহিন শহর দিঘির তার বাড়িতে তালা মেরে পরিবারসহ পালিয়ে গেছেন।

জেলা পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা বলেন, পুরো জেলায় অভিযান শুরু হয়েছে। শিবগঞ্জে আমরা কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছি। অভিযান অব্যাহত থাকবে।

রাজশাহীতে বিষাক্ত মদ পানে ছয়জনের মৃত্যু: রাজশাহীতে থার্টি ফার্স্ট নাইটে বিষাক্ত মদপানে ছয়জনের মৃত্যু হয়। জানা যায়, সে রাতে তারা বিভিন্ন স্থানে মদ পান করেছিলেন। মৃত ছয়জন হলো-রাজশাহী মহানগরীর হোসনীগঞ্জ এলাকার আইনুল ইসলামের ছেলে ফয়সাল হোসেন (২৮), বাকির মোড় এলাকার উত্তমের ছেলে সাগর (২৫), হেতমখাঁ এলাকার মৃত লুৎফর রহমানের ছেলে তুহিন (২৬), কাদিরগঞ্জ এলাকার সেলিম আহমেদের ছেলে মুন আহম্মেদ (১৮) এবং জেলার বাগমারা উপজেলার শান্তাপাড়া এলাকার রফিকুল ইসলামের ছেলে সজল (২৫) ও ইশাকুল ইসলাম (২২)।

লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলোয় সীমাবদ্ধতা: মাদক আমদানিতে দেশের হাতে-গোনা কিছু প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স রয়েছে। এর মধ্যে ৫ তারকা মানের হোটেলগুলো অন্যতম। অনুসন্ধানে জানা গেছে, করোনার কারণে আন্তর্জাতিকভাবে মদ উৎপাদন ও সরবরাহের ওপর একটা বড় প্রভাব পড়েছে। যার ধাক্কা সম্প্রতি বাংলাদেশেও লাগতে শুরু করেছে। যে কারণে দেশের ভেজাল মদ ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া হয়ে পড়েছেন। তারা পুরাতন বিদেশি মদের বোতলে ভেজাল মদ ভরে বিদেশি ও পানের উপযোগী মদ বলে চালিয়ে দিচ্ছেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, বৈধভাবে যারা মদ আমদানি করেন, তারা আমাদের কাছ থেকেই লাইসেন্স নিয়ে থাকেন। মহামারী করোনার কারণে এই সেক্টরেও একটা ধাক্কা লেগেছে। যে কারণে সম্প্রতি ভেজাল মদের ছড়াছড়ি খবর পাওয়া যাচ্ছে। যে কারণে মদ পানকারী মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে।

নেপথ্যে চোরাই পথে প্রতিবন্ধকতা: সীমান্তে ও দেশের বিভিন্ন বন্দরে মাদক প্রবেশ প্রতিরোধে দায়িত্বপালনকারী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, করোনার আগে বিভিন্ন সময়ে চোরাইভাবে মদ প্রবেশ করত। গোপন তথ্য বা তল্লাশি করে সেগুলো ধরা হতো। তবে তার একটি বড় অংশ চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ত দেশের বাজারে, যা অবৈধ মদ পানকারীদের কাছে বিক্রি হতো। কিন্তু করোনার কারণে দেশে কনটেইনারসহ বিভিন্নভাবে মদ প্রবেশ করতে না পারার কারণে সারা দেশেই ভেজাল মদ ছড়িয়ে পড়ে।

তরল মাদকের (অ্যালকোহল) প্রকারভেদ: মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, প্রাথমিকভাবে অ্যালকোহলকে ৩টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলো হলো-ইথানল (যাকে ইথাইল অ্যালকোহলও বলা হয়), মিথানল (যাকে মিথাইল অ্যালকোহল, উড অ্যালকোহল, উড ন্যাপথা, উড স্পিরিটও বলা হয়) এবং রেকটিফাইড স্পিরিট (যাকে মেথিলেটেড স্পিরিটও বলা হয়)।

মাদকের সহনীয় মাত্রা: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারি অধ্যাপক প্রবীণ বোস আগামী নিউজকে বলেন, অ্যালকোহল বা মদ মানবদেহের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর। বাংলাদেশে সাধারণত অ্যালকোহল নিষিদ্ধ। তবে বিদেশের মানুষজন মদ পানে পারমিটেড এবং তারা পিউর অ্যালকোহল পান করেন। কিন্তু আমাদের দেশে হাতে-গোনা কিছু লোক ছাড়া মদ পান করেন। কারোই লাইসেন্স নেই। তা ছাড়া আমাদের দেশে যে মদ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ভেজাল রয়েছে, যে কারণে মদে আসক্তরা মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছেন।

ঐ চিকিৎসক আরও বলেন, বিষাক্ত মদ মানুষের লিভার, কিডনি এবং মস্তিষ্কসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কার্যকারিতা নষ্ট করে ফেলে। এ কারণেই মৃত্যু ঘটে।

জানা গেছে, ইথানল ব্যবহার করা হয় হোমিও প্যাথিক ঔষধ তৈরিতে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ তৈরিতে জড়িতদের মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ ইথানল দেয়া হয়। তবে কি পরিমাণ মান্থলি দেয়া হয় তা জানা যায়নি। তবে এই ইথিনাল ঔষধ তৈরির কাজে যতটুকু ব্যবহার করা হয় তার চেয়ে বেশি বিক্রি হয় খোলাবাজারে। আর খোলাবাজার থেকে ইথানল কিনে ভেজাল মদ তৈরি করে তা পানের ফলে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছেন মাদকাশক্ত মানুষ। কি পরিমাণ ইথানল হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানকে প্রতিমাসে দেয়া হয় এবং তারা এর ব্যবহার করছেন কিভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করছেন কি'না সামগ্রীক বিষয়ে জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মুখ খুলতে নারাজ। 

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা মাসে কি পরিমাণ ইথানল হোমিও ঔষধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া তা উল্লেখ না করে বলেন, আমরা নির্দিষ্ট পরিমাণ তাদেরকে সরবরাহ করি। তবে সেটা তারা খোলাবাজারে বিক্রি করছেন কি না তা আমাদের জানা নেই। 

আগামীনিউজ/এএইচ