বরগুনাঃ দেশের উপকূলীয় জনপদ বরগুনার বেতাগীতেও স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিরে বইছে আবেগ, আনন্দ উচ্ছাস। গোটা উপজেলাজুড়ে পদ্মা সেতুর সুফল ও উন্নয়নের আশায় এখন উজ্জীবিত এলাকাবাসী।
স্থানীয়রা বলছেন, সেতুটি চালু হলে এখানকার জনগোষ্ঠির যাতায়াতে কষ্ট লাঘব ও সময় বাঁচবে। বাড়বে মানুষের যাতায়াত ও পরিবহণ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈপ্লাবিক পরিবর্তন আনবে যেখানে সেতুর অভাবে ফেরিঘাটে যানজটে যুগের পর যুগ ধরে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়ে আসছিলেন। যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে অপেক্ষার শেষ ছিলোনা। বাসিন্দাদের দিন, কখনো রাতও পার হয়ে যেত। কিন্ত এখন দিনে দিনেই বেতাগী থেকে ঢাকাায় কাজ শেষ করে আবার গন্তব্যে ফিরে আসতে পারবে। এতে আগের তুলনায় অর্ধেকটা সময় বেঁচে যাবে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভাবনীয় উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যে, গ্রামীণ অর্থনীতির প্রসার, নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। বদলে যাবে আর্থসামাজিকচিত্র।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পদ্মা সেতুকে ঘিরে গোটা বরিশাল-বেতাগী-বরগুনা আঞ্চলিক সড়কের দুইপাশে অনেকেই ইতোমধ্যে জমি কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাদের উদ্দেশ্যে ছোট-বড় বিভিন্ন কল-কারখানা গড়ে তোলার।
বরগুনা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব শওকত হাচানুর রহমান রিমন বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যার দূরদৃষ্টি ও সৎ সাহসের ফসল পদ্মা সেতু। এটা আমাদের একটা বড় অর্জন ও উদাহরণ। ঢাকার সাথে যাতায়াত দ্রুত ও সহজ হবে। মানুষের স্বাভাবিক যাতায়াতের পাশাপাশি এলাকার সঙ্গে সকলের যোগাযোগ, সামাজিকদৃঢ়তা বাড়বে। অর্থনীতিকে পাল্টে দেবে।
৩১৫- সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য সুলতানা নাদিরা বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের মধ্যে সক্ষমতা ও নতুন আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছে। এ সেতু সবার জন্য একটি মাইলফলক এবং দক্ষিনা জনপদে ব্যাপক সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে।
বেতাগী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: সুহৃদ সালেহীন বলেন, রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হচ্ছে এ উপজেলা। এতে প্রশাসনিক কর্মকান্ডের গতিশীলতা বৃদ্ধি ও প্রশাসনের উর্চ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে সু-সম্পর্ক তৈরি এবং তাদের সুনজড় বাড়বে।
বেতাগী পৌরসভার মেয়র আলহাজ্ব এবিএম গোলাম কবির বলেন, সেতু বাস্তবায়নের ফলে এখন আমরা আত্মপ্রত্যয়ী। সেতু নির্মাণের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কারণে স্থানীয় সকল ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়ন সহজতর হবে। দুর্গম হওয়ায় আগে যেখানে কর্মকর্তারা সহজে আসতে চাইতো না এখন সেখানে ঢাকা থেকে বড় বড় কর্মকর্তরা এখানে আসতে আগ্রহী হবেন।
ঢাকাস্থ বেতাগী প্রগতি ফোরামের সভাপতি বিশিস্ট শিল্পপতি আলহাজ্ব গোলাম কুদ্দুস বলেন, নতুন নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনে শিল্পমালিকদের মাঝে আগ্রহের সৃষ্টি হবে। গড়ে উঠবে শিল্প-কারখানাসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বাড়বে মানুষের কর্মসংস্থান ও কমবে বেকার সমস্যা। উজ্জীবিত হবে কৃষি, পর্যটন ও পরিবহন সেক্টর।
বেতাগী উপজেলা চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমান ফোরকান বলেন, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে দেশের শীর্ষ স্থানীয় লোকজনের পদচারনা বৃদ্ধি পাবে। এখানকার বিভিন্ন উন্নয়নের পাশাপাশি ঢাকা থেকে সরাসরি বেতাগী-ঢাকা সরাসরি বাস যোগাযোগ চালু হলে বদলে যাবে সকলচিত্র।
উপজেলার কৃতি সন্তান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) অতিরিক্ত সচিব খান মো. রেজাউল করিম বলেন, আগে যেখানে ঢাকায় বসবাসরত বেতাগীর বাসিন্দারা বছরে দুই-একবার গ্রামের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতো। এখন যোগযোগের উন্নয়নের কারণে গ্রামে ঘনঘন আসা-যাওয়া বাড়বে।
আরেক কৃতি সন্তান মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শ্যামল চন্দ্র কর্মকার বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে এখানকার মানুষের সুখের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এ সেতুর মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল হবে। পদ্মা সেতু শুধু সেতু নয়, এটি আমাদের বঞ্চনার পরিসমাপ্তির উপাখ্যান।
এর আগে যোগাযোগের অভাবে কাজের খোঁজে এলাকা ছেড়েছে মানুষ। পদ্মা সেতু চালু হলে আবার ফিরবে গ্রামের মানুষ। নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরবে। কৃষি, যোগাযোগ, নগরায়ন, জীবনমানে বৈপ্লাবিক পরিবর্তন আসবে।
বেতাগী বন্দর ব্যবসায়ী সমিতির আহবায়ক পরেশ চন্দ্র কর্মকার বলেন, পদ্মা সেতু ঘিরে এখানেও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়নের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। খুব কম সময়ে বেতাগী থেকে ঢাকায় যাওয়া যাবে। ঢাকার সঙ্গে পণ্যপরিবহনের খরচ কমে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরবে।
উপজেলা কৃষি ও মৎস্য কর্মকর্তা মো: ইসা ও আ: গাফ্ফার বলেন, কৃষি ও মৎস্য নির্ভর এ উপজেলায় মৎস্য খাতে ‘পদ্মা সেতু’র ব্যাপক প্রভাব পড়বে, এখানকার উৎপাদিত ধান-চাল, খড়, সবজি, ডাব, নারিকেল, সুপারি, পান, ডাল, আমাড়া, লেবু, মাছ ও দুধ ঢাকায় যাবে। এতে এলাকা ভিত্তিক রপ্তানি আয় বাড়বে। আনবে বৈপ্লাবিক পরিবর্তন।
বেতাগী নাগরিক ফোরামের সভাপতি লায়ন মোহাম্মদ শামীম সিকদার বলেন, মানুষের চলাচল বাড়বে। খুলবে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। গ্রামীণ সার্বিক কর্মকান্ডে গতি সঞ্চার হবে। নাগরিক সেবাবৃদ্ধি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে গতি ফিরবে। নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে আগ্রহী হওয়ার উজ্জল সম্ভাবনা রয়েছে।
বেতাগী প্রেসক্লাবের সভাপতি আব্দুস সালাম সিদ্দিকী বলেন, সংবাদ প্রবাহ বৃদ্ধি ও সকালে পত্রিকা হাতে পাওয়া যাবে। এজেন্টরা দ্রুত পাঠাকের হাতে পত্রিকা পৌঁছাতে পারবে। স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের সাথে সখ্যতার পাশাপাশিখ বিশেষ করে ঢাকার সাংবাদিকদের সাথে সেতুবন্ধন তৈরি হবে।
সবার জন্য সুশাসন ণাগরিক (সুজন) উপজেলা কমিটির সভাপতি সাইদুল ইসলাম মন্টু বলেন, সেই স্বপ্নের ও শত আশার সেতু, পদ্মা সেতু এখন বাস্তব। এখানকার অনেকেই কল্পনা করতে পারেনি, পদ্মা সেতু হবে। এতে কত মানুষের যে উপকার হয়েছে তা পরিসংখ্যান করে সঠিক বলা যাবেনা। বিশেষ করে রোগীরা যখন পদ্মা সেতু দিয়া যাবে, তখন প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া করতে করতে যাবেন।’
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ.কে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আ: হাই জানান, শিক্ষার্থীদের ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার সূযোগ তৈরি হবে। মেধার বিকাশ ঘটবে ও জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে। পাশাপাশি স্বল্প সময় ও স্বল্প খরচে পড়তে পারবে।
উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো: মহসিন খান বলেন, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো: মহসিন খান বলেন, পদ্মা সেতুকে ঘিরে দুর্নীতি সংকুচিত হয়ে আসার সম্ভবানা রয়েছে। যোগাযোগ সহজতর হওয়ার কারণে উর্ধতন কর্মকর্তরা চাইলে দ্রæত তদন্ত কিংবা পরিদর্শনে আসলে দুর্নীতির সূযোগ কমবে।
পদ্মা সেতু হওয়ায় অসুস্থ রোগীকে সঠিক সময়ে চিকিৎসাসেবা দিয়ে জীবন বাঁচানো যাবে এমনটাই আশা দক্ষিণা এ জনপদের মানুষের। বেতাগী হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সের চালক মো. হুমায়ূন কবির (হিরু)। দীর্ঘ ১৩ বছর হাসপাতালের রোগী বহন করছেন তাঁর অ্যাম্বুলেন্সে। রোগী নিয়ে বিভিন্ন সময়ে তাঁকে যেতে হয় ঢাকায়। তবে ঘাটে ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে করতে মুমূর্ষু অনেক রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় অনেক রোগীকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে তাঁর অ্যাম্বুলেন্সে। তিনি বলেন, ‘তখন পদ্মা সেতু থাকলে রোগীদের হয়তো হাসপাতালে পৌঁছে দিতে পারতাম।
বেতাগী উপজেলা পরিষদের সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রভাষক আমিনা বেগম বলেন, নারী ও শ্রমজীবী মানুষের কর্মের সূযোগবৃদ্ধি পাবে। দ্রæত যাতায়াতের কারণে ঢাকায় গিয়ে তারা বেশি কাজ করে অধিক পরিমানে আয় করতে পারবে। এতে তারা নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে স্বালম্বী হয়ে উঠবে।
পদ্মা সেতুর দ্ধার উম্মোচনে যুবকরা তাদের জীবনমান্নোয়নে নতুন করে স্বপ্ন দেখবে। এমনই আশা ব্যক্ত করেন ধ্রুবতারা ইয়ূথ ডেভেলপ ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো. অলি আহম্মেদ। এই যুবসংগঠক দাবি করেন, এখন সময়ের প্রয়োজনে যুবকদের দক্ষতাবৃদ্ধিকল্পে নানামুখি উদ্যোগ গ্রহণ দরকার।
তবে শত এ আশার সেতু পদ্মা সেতুর সুফল পেতে দেড়লাখ জনসংখ্যা অধ্যূষিত এ উপকূলবাসী কতটুকু প্রস্তুত স্থানীয়দের মাঝে এমনই প্রশ্নের ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদের প্রত্যাশা এখন সবচেয়ে প্রয়োজন সড়ক, ব্রিজ ও কালভার্ট প্রসস্তকরণসহ নানামূখি উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি সুষ্ঠু ও কার্যকরি পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া। না হয় বাড়বে দূর্ঘটনা, ব্যহত হবে স্বপ্ন ও অর্জণ।
সাইদুল ইসলাম মন্টু/এমবুইউ