পঞ্চগড়ঃ রুবিনা ভালো ভাবেই পড়াশোনা করতেছিলেন হঠাৎ একদিন রুবিনার জীবনের কালো মেঘ নেমে আসে। সেই ঘটনাটি ঘটে ২০১৮ সালে। এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া রুবিনা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। পড়াশোনা করতেন মেসে থেকে। একটি ব্যাংকের শিক্ষাবৃত্তি ও প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের পড়ালেখার খরচ যোগার করতেন তিনি। একদিন ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার জন্য কমলাপুর রেল স্টেশনে যান রুবিনা। সেখানেই পড়েন দুর্ঘটনার কবলে। এক প্লাটফর্ম থেকে আরেক প্লাটফর্মে যাওয়ার সময় মাথা ঘুরে রেললাইনের ওপর পড়ে যান তিনি। এ সময় একটি রেল ইঞ্জিন ঘোরানো হচ্ছিল। ওই ইঞ্জিনের চাকার নিচে কাটা পড়ে রুবিনা আক্তারের দুই পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
সেই রুবিনা এখন চলাফেরা করেন হুইল চেয়ারে। তবে দরিদ্র পরিবারেও বোঝা হননি তিনি। দুর্ঘটনায় পা হারিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে পাওয়া চিকিৎসা সহায়তার এক লাখ টাকা দিয়ে শুরু করেন গরু মোটাতাজাকরণ। তিন বছরে তৈরি করেছেন ১১ মণ ওজনের একটি ষাঁড়। যার নাম রেখেছেন ‘স্বপ্নরাজ’। স্বপ্নরাজের কাঙ্খিত দাম পেলে পরিবারে অনেকটাই স্বচ্ছলতা ফিরে আসবে বলে প্রত্যাশা রুবিনার।
রুবিনার বাড়ি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার দণ্ডপাল ইউনিয়নের বিনয়পুর জংলী পাড়া এলাকায়। তার বাবার নাম মৃত রবিউল ইসলাম। রুবিনার বাবা রবিউল ইসলাম ছিলেন দিনমজুর। ২০১৪ সালে মারা গেছেন তিনি। সম্বল বলতে চাষের দেড় বিঘা জমি। তারা দুই বোন ও এক ভাই। বোনের মধ্যে তিনি ছোটো। বড় বোন জুলেখা খাতুন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, বাড়িতেই থাকেন।
সম্প্রতি রুবিনার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, হুইল চেয়ারে বসেই ১১ মণ ওজনের স্বপ্নরাজের দেখভাল করছেন তিনি। ঘাস কেটে দিচ্ছেন, পানি খাওয়াচ্ছেন। একইভাবে অন্যান্য কাজও করেন রুবিনা। সব দিক থেকে তাকে সহযোগিতা করেন মা রহিমা বেগম।
কথা হয় রুবিনার সঙ্গে। তিনি আগামী নিউজকে (১৫ জুন) বুধবার বিকেলে জানান, দুই পা হারিয়ে বাড়ি এসে সিদ্ধান্ত নেন গরু পালনের। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া চিকিৎসা সহায়তার সেই টাকাটা দিয়ে একটি গাভী ও বাছুর কিনেন তিনি। তবে অভাবের কারণে গাভীটিকে বেশিদিন রাখতে পারেননি। গাভী বিক্রি করে যত্ন নেয়া শুরু করেন বাছুরটির। মাতৃস্নেহে সেই বাছুরটিকে বড় করে তুলেন তিনি। এই ষাঁড়টিকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। তাই এর নাম দিয়েছেন ‘স্বপ্নরাজ’।
তিনি জানান, স্বপ্নরাজকে প্রাকৃতিক উপায়েই বড় করেছেন তিনি। প্রতিদিন ব্যবসায়ীরা আসছেন স্বপ্নরাজকে কিনতে। তবে দামের বনিবনা না হওয়ায় বিক্রি করছেননা। বর্তমান স্বপ্নরাজের পিছনে দৈনিক ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা খরচ করতে হয় বলে জানান রুবিনা। এতে হিমশিমও খেতে হয় তাদের। তারপরও স্বপ্ন দেখেন কুরবানীর হাটে ভালো দামে বিক্রি করার। প্রত্যাশীত দাম পেলে স্বচ্ছলতা ফিরে আসবে পরিবারে।
তবে রুবিনার আক্ষেপের যেন শেষ নেই। তিনি বলেন, দুই পা হারিয়ে চার বছর ধরে ঘরবন্দি রয়েছি। কেউ খোঁজ নেয়নি। প্রতিবন্ধী ভাতাও মিলেনি এখনো। আবেদন করেও কাজ হয়নি জানি না আল্লাহ আমার ভাগ্যে কি রেখেছেন।
রুবিনার মা রহিমা বেগম বলেন, স্বপ্নরাজকে নিয়েই আমাদের মা-মেয়ের সারাদিন কাটে। দুজনে সামলাতে পারিনা। তারপরও করার কি আছে? শ্রমিক নিয়ে কাজ করাবো এমন সাধ্যওতো নেই। মেয়ের স্বপ্ন স্বপ্নরাজকে বিক্রি করে পরিবারের অস্বচ্ছলতা দুর করবে, ছোট ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ যোগাবে। অবশিষ্ট টাকা দিয়ে আমরা বড় পরিসরে একটা গরুর খামার করতে চাই। এজন্য যদি কোন সহযোগিতা পেতাম তাহলে বড় উপকার হত।
দণ্ডপাল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আজগর আলী বলেন, রুবিনা এতদিনেও প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেনা এটা দুঃখজনক। আমি নতুন চেয়ারম্যান হয়েছি, যে কোন সুযোগ সুবিধা এলে তাকে দেয়া হবে। ওই পরিবারে আমার সুদৃষ্টি সবসময় থাকবে।
উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ সারবনতহুরা বলেন, আমি কয়েক মাস আগে রুবিনার বাড়িতে গিয়েছিলাম তার গরু দেখতে। প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের কোন সুযোগ সুবিধা আসলে তাকে দিব।
শেখ ফরিদ/এমবুইউ