সৈয়দপুরে ইউপি নির্বাচনে নৌকার ভরাডুবি তিন কারণে

জিকরুল হক, উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি ডিসেম্বর ২৮, ২০২১, ১২:১২ পিএম
ফাইল ছবি

নীলফামারীঃ জেলার সৈয়দপুরে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে নৌকা মার্কার ভরাডুবি হয়েছে তিন কারণে। গত ২৬ ডিসেম্বর এ উপজেলার ৫ ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোটের ফলাফলে বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়ী হয় তিন ইউনিয়নে। আর একটি ইউনিয়নে জাকের পার্টি অন্যটিতে বিজয়ী হয় নৌকা মার্কার প্রার্থী। ইউপি নির্বাচনে নৌকা মার্কার পরাজয়ের বিষয়ে অনুসন্ধানে নামলে তিনটি কারণ উঠে আসে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো প্রার্থী বাছাইয়ে অনিয়ম। অন্য দুটি হলো দলের আভ্যন্তরিন কোন্দল ও ভোটারদের মেজাজ আমলে না নেয়া। ইউনিয়নগুলোতে সরেজমিন ঘুরে ও বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে নৌকার ভরাডুবির জন্য ওই তিন কারণ উঠে আসে। 

কথা হয় খাতামধুপুর ইউনিয়নের ভোটার জগেন চন্দ্র, মহুয়া রায়, শামসুল, আলী আহমেদ ও খুট্ট মামুদের সঙ্গে। তারা জানান, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এ ইউনিয়নের ভোটাররা উত্তর-দক্ষিণ অংশে ভাগ হয়ে যায়। দক্ষিণাংশে নেতৃত্বে দেন মরহুম বীরমুক্তিযোদ্ধা মোখলেছুর রহমানের পরিবার। উত্তরাংশে নেতৃত্বে থাকে মরহুম আজিজুল ইসলাম চৌধুরীর পরিবার। যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। বলতে গেলে এটি ইউনিয়নের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এবারেও তার ব্যতয় ঘটেনি। দুই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়। তাদেরই ভোটে জয় পরাজয় ঘটে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মোটর সাইকেল মার্কা নিয়ে নির্বাচিত হয়েছে আ’লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বীরমুক্তিযোদ্ধা মোখলেছুর রহমানের ছেলে মাসুদ রানা পাইলট বাবু। প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী ছিলেন আজিজুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে আনারস মার্কার প্রার্থী জুয়েল চৌধুরী। আ’লীগের আভ্যন্তরিন কোন্দলকে ঘিরে এ ইউনিয়নে নৌকা মার্কার প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পান হাসিনা বেগম। তিনি ভোট পেয়েছেন মাত্র ৯৩টি। ওইসব ব্যক্তিদের মতে ভোটারদের মেজাজ বুঝে যদি মাসুদ রানা পাইলট বাবুকে নৌকা প্রতীক দেয়া হতো, তাহলে খাতামধুপুরের মাটিও নৌকা নৌকা বলতো। কিন্তু তা করা হয়নি। তাদের মতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আ’লীগের কোন কেন্দ্রীয় নেতাকে যদি এ ইউনিয়নে প্রার্থী করা হয় তবুও ওই দুই পরিবারের বাইরে সেই নেতাও বিজয়ী হতে পারবে না। অথচ এ ইউনিয়নে সংখ্যালঘু ভোটার প্রায় আড়াই হাজার। এসব ভোটাররা জাতীয় নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দেয়। স্থানীয় নির্বাচনে ঘটে ব্যতিক্রম। বলতে গেলে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে কাশিরাম ইউনিয়নে। এই ইউনিয়নে নৌকা মার্কার মনোনয়ন দেয়া হয় গোলাম রকিব সোহনকে। আ’লীগের মনোনিত এই ব্যক্তি কোন সময় ইউনিয়ন বা সৈয়দপুর উপজেলায় আ’লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। ভোটারদের সঙ্গে ছিলো না তার কোন পরিচিতি বা আত্মিক সম্পর্ক। নীলফামারী জেলা শহরে তিনি বেড়ে উঠেছেন। স্বভাবতঃ কারণেই বিদ্রোহী প্রার্থী হন ইউনিয়ন আ’লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বজলুর রহমান বুলবুল চৌধুরী। এই প্রার্থী আনারস মার্কা নিয়ে ভোটের মাঠে লড়েন। ভোট পেয়েছেন ৪৯৫২। অথচ নৌকা মার্কার প্রার্থী ২৫৪১ ভোট পেয়েছেন। কথা হয় এই ইউনিয়নের ভোটার আনারুল, জাহাঙ্গীর, দুলাল, জিয়া, মনেজা ও ফাতেমার সঙ্গে। তারা জানান, বুলবুল চৌধুরী বাবা মরহুম এনামুল হক চৌধুরী ছিলেন চারবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। ছিলেন ইউনিয়ন আ’লীগের দীর্ঘদিনের সভাপতি। ইউনিয়নের নির্বাচনে ওই চৌধুরী পরিবার থেকে বারবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। এবারেও চৌধুরী পরিবারের সন্তান জাকের পার্টির মনোনিত গোলাপ ফুল মার্কার প্রার্থী লান্চু হাসান চৌধুরী চেয়ারম্যান পদে বিজয়ের মালা গলায় পড়েন। কিন্তু ইউনিয়নের ভোটারদের মেজাজ না বুঝে নেতার পছন্দের ব্যক্তিকে করা হয় নৌকা মার্কার প্রার্থী। যার জন্যই নৌকার ভরাডুবি ঘটেছে। কামারপুকুর ইউনিয়নে আ’লীগের ইউনিয়ন সভাপতি (বর্তমানে বহিস্কৃত) আনোয়ার হোসেন সরকার ও সাধারণ সম্পাদক জিকো আহমেদকে নৌকা মার্কার প্রার্থী করার অভয় দেন উপজেলা পর্যায়ের নেতারা। সেই আশ্বাসেই তারা দু’জনেই দীর্ঘদিন ধরে ভোটের মাঠ চসে বেড়ান। অথচ দলের আভ্যন্তরিন কোন্দলে মনোনয়ন পান জিকো আহমেদ। এমন অবস্থায় রাগে ক্ষোভে দুঃখে ও অবিশ্বাসের আগুনে পুড়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হন আনোয়ার হোসেন সরকার। এই প্রার্থী মোটর সাইকেল মার্কা প্রতীক নিয়ে ২৯১ ভোট নৌকার চেয়ে বেশি পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি থাকে নৌকা মার্কার প্রার্থী জিকো আহমেদ। এ ইউনিয়নেও ভোটারদের মেজাজ আমলে নেয়া হয়নি। প্রার্থী বাছাইয়ে করা হয় অনিয়ম। এমন অভিযোগ ভোটার মোজাহিদ, শামসুদ্দিন, আবুল কালাম, মনোয়ার ও কবির করেছেন। 

উপজেলার সর্ববৃহৎ ইউনিয়ন বোতলাগাড়ী। এ ইউনিয়নে নৌকা মার্কার চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে অঘোষিত প্রার্থী ছিলো ইউনিয়ন আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক (বর্তমানে বহিস্কৃত) মনিরুজ্জামান সরকার জুন। তিনি দলের নিশ্চিত মনোনয়ন পাবেন এমন আশা বুকে নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে গোটা ইউনিয়নের মানুষের দ্বারে দ্বারে গেছেন। হঠাৎ ভোটের মাস ছয়েক আগে ভোটের মাঠে চলে আসে ইউনিয়ন আ’লীগের সভাপতি প্রভাষক আব্দুল হাফিজ হাপ্পু। জুনের চেয়ে হাপ্পুর রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো হওয়ায় নৌকা মার্কার মনোনয়ন সেই পায়। কিন্তু ভোটারদের মতামত চলে যায় পুরোপুরি হাপ্পুর বিপক্ষে। ফলে বিদ্রোহী প্রার্থী হয় মনিরুজ্জামান সরকার জুন। ঘোড়া মার্কা প্রতীক নিয়ে জুন বিজয় ছিনিয়ে আনে। নৌকা মার্কার প্রার্থী এই ইউনিয়নে ভোটের ফলাফলে চার নম্বর হয়। এই ইউনিয়নেও দলের অভ্যন্তরিণ কোন্দলের কারণেই ভোটারদের মেজাজ আমলে না নিয়ে নেতা নিজের পছন্দ মতো প্রার্থী দেয়ায় নৌকার ভরাডুবি ঘটেছে। কথা হয় বোতলাগাড়ী ইউনিয়নের ভোটার মজিবর, জাহাঙ্গীর, মতিয়ার, লোকমান, ইউনুস ও ফজলুর সঙ্গে। তারা অভিযোগ করে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মার্কার চেয়ে ব্যক্তি প্রধান্য বেশি। যে প্রার্থীর যতো বেশি সম্পর্ক ভোটারদের সঙ্গে থাকে তেমন প্রার্থীই নির্বাচনে ভালো ফল বয়ে আনে। যেমনটি জুনের ক্ষেত্রে হয়েছে। নৌকার একক প্রার্থী ছিলেন বাঙ্গালীপুর ইউনিয়নে ডাঃ শাহজাদা সরকার। এ ইউনিয়নে নেতারা খেলার তেমন সুযোগ না পাওয়ায় খুব সহজেই তিনি নৌকা মার্কা নিয়ে বিজয়ী হন। রেখেছেন নৌকার মান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় পৌর আ’লীগ থেকে রাজাকার পুত্র দিলনেওয়াজ খানকে বহিস্কার করা নিয়ে স্থানীয় আ’লীগ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে তৃনমূল পর্যায়ের বড় অংশ দলকে রাজাকার মুক্ত করতে অনড় অবস্থান নেয়। রাজাকার বিরোধী লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক মহসিনুল হক মহসিন, পৌর আ’লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বাবু, সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক ও নবপ্রজন্মের প্রিয় ও বুদ্ধিদীপ্ত আ’লীগ নেতা প্রকৌশলী একেএম রাশেদুজ্জামান রাশেদ। এদিকে রাজাকার পুত্র দিলনেওয়াজ খানকে রক্ষায় প্রকাশ্যে অবস্থান নেয় উপজেলা আ’লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মোখছেদুল মোমিনসহ তার অনুসারিরা। পক্ষ-বিপক্ষ অবস্থান নিয়ে শুরু হয় আন্দোলন। যা রাজপথ পর্যন্ত গড়ায়। এমন অবস্থায় ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নেও তার প্রভাব পড়ে। নিজের পছন্দের প্রার্থীকে মনোনয়ন পাইয়ে দিতে শুরু হয় জোর গ্রুপিং লবিং। কালো টাকার ছড়াছড়ি। এ পরিস্থিতিতে জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে থাকারা মনোনয়ন লাভে সফল হন। কিন্তু জনগন ছাড়া ভোটযোদ্ধা নৌকা মার্কার প্রার্থীরা নির্বাচনে হয়ে যান ধরাশায়ী। ভরাডুবি ঘটে নৌকার। ইউপি নির্বাচনে নৌকার বিপর্যয় নিয়ে কথা হয় উদীয়মান আ’লীগ নেতা প্রকৌশলী একেএম রাশেদুজ্জামান রাশেদের সঙ্গে। তিনি বলেন বিচারিক আসন নির্মোহ না থাকলে রায় কখনো সার্বজনিন হয় না। ফলে দোষি হয় নির্দোষ এবং নির্দোষ হয় দোষি। এমন অবস্থা হয়েছে ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে। তাই ফল যা হবার তাই হয়েছে। পৌর আ’লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বাবু বলেন, জনগনের মেজাজ না বুঝে, ভবিষ্যৎ না ভেবে নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে প্রার্থী করায় ইউপি নির্বাচনে নৌকার ভরাডুবি ঘটেছে। প্রার্থী বাছাইয়ে যদি প্রকাশ্যে এবং গোপনে নির্মোহ অনুসন্ধান চালিয়ে নির্বাচন করা হতো তাহলে নৌকার ভরাডুবি ঘটতো না। নৌকার ভরাডুবি ঘটায় আমরা হতভম্ব। উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক মহসিনুল হক মহসিন বলেন, দলের আভ্যন্তরিন সমস্যা, প্রার্থী বাছাইয়ে অযোগ্যতা এবং তৃনমূলের ভোটারদের মেজাজ আমলে না নিয়ে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ায় নৌকার নিশ্চিত পরাজয় ঘটেছে। এ ব্যর্থতা দল ও দেশের জন্য ক্ষতিকর। তবে তিনি এও বলেন ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছি। 

আগামীনিউজ/নাসির