নীলফামারী: জেলার সৈয়দপুরে ইউপি নির্বাচন বেশ জমে উঠেছে। প্রার্থীরা কাকডাকা ভোরে উঠে গভীর রাত পর্যন্ত গণসংযোগ করছেন। প্রার্থীদের পক্ষে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে পথসভা। সাধারণ ভোটাররা পথসভায় অংশ নিয়ে প্রার্থী ও তাদের অনুসারীদের বক্তব্য শুনছেন। ভোটারদের পক্ষে টানতে অনেক প্রার্থী উন্নয়ন নিয়ে কথা বলছেন। প্রার্থীদের মার্কার প্রতি ভোটারদের আকর্ষণ বাড়াতে বাহারী ঢংয়ের রেকর্ডকৃত গান মাইকে বাজানো হচ্ছে।
আগামী ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে সৈয়দপুর উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের ভোট। ভোটের দিনক্ষণ যত ঘনিয়ে আসছে ততই প্রার্থী সমর্থকদের মাঝে উত্তাপ বাড়ছে।
সবচেয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে ৫নং খাতামধুপুর ইউনিয়নে। ইতোমধ্যে নির্বাচনী সংঘর্ষের ঘটনায় খাতামধুপুর ইউনিয়নের দুই চেয়ারম্যান প্রার্থী তথা জুয়েল চৌধুরী (আনারস) ও মাসুদ রানা পাইলট বাবু (মোটরসাইকেল) পাল্টাপাল্টি মামলা করেছেন থানায়। মামলা দায়েরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন সৈয়দপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল হাসনাত খান।
এর আগে খাতামধুপুরের আ’লীগের পাঁচ নেতা-কর্মী হিন্দু ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং অফিসার উপজেলা প্রকৌশলী এমএম আলী রেজা রাজু বরাবরে লিখিত অভিযোগ দেয়। অভিযোগ পাওয়ার সত্যতা জানান ওই রিটার্নিং কর্মকর্তা। তবে যে ইউনিয়নে যা কিছুই ঘটুক না কেন, আলোচনার শীর্ষে রয়েছে সরকারি দল আ’লীগ সমর্থিত নৌকা মার্কার চেয়ারম্যান প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা নিয়ে।
সরেজমিনে পাঁচ ইউনিয়ন ঘুরে নানা পেশার মানুষের সঙ্গে নৌকা মার্কার প্রার্থীদের নিয়ে ভোটাররা যা মন্তব্য করেছেন তারই চুম্বক অংশ পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো।
উপজেলার ১নং কামারপুকুর ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী হয়েছেন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক জিকো আহমেদ। তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন সভাপতি আনোয়ার সরকার (মোটরসাইকেল)। চেয়ারম্যান থাকাকালীন জিকো আহমেদের নারী কেলেংকারীর ঘটনা ভোটারদের মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জনবান্ধব নেতা হিসাবে পরিচিত বিদ্রোহী প্রার্থী নৌকা মার্কার প্রার্থীর চেয়ে জনপ্রিয়তায় বেশ এগিয়ে রয়েছে। কথা হয় এ ইউনিয়নের ভোটার সামসুদ্দিন, আজগর, মনিরা, হাসিনা ও আউয়ালের সঙ্গে। তারা বলেন ভোটারদের কাছে জিকোর চেয়ে আনোয়ার সরকারের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
২নং কাশিরাম ইউনিয়নে আ’লীগের মনোনয়ন পেয়ে নৌকা মার্কার চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন গোলাম রব্বানী সোহন। এই প্রার্থীর ইউনিয়নে কোন পরিচিতি নেই। এমনকি ইউনিয়ন আ’লীগের রাজনীতির সঙ্গে কোন সময় ছিল না তার কোন ঘনিষ্ঠতা। ফলে অপরিচিত মুখ ভোটারদের কাছে প্রায় অগ্রহণযোগ্য বলেই বিবেচিত হচ্ছে। তবে এ ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন ইউনিয়ন আ’লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বজলুর রশিদ বুলবুল চৌধুরী। তিনি আনারস মার্কা নিয়ে ভোটের মাঠে এগিয়ে যাচ্ছেন।
কথা হয় এই ইউনিয়নের অধিবাসী রবি, আলম, সকুল, মুজিব, হাবিব, তাহেরা, আমজাদের সঙ্গে। তারা অভিযোগ করে বলেন, আমরা নৌকা মার্কার সমর্থক। কিন্তু নৌকা মার্কা নিয়ে যিনি প্রার্থী হয়েছেন, শুনেছি তিনি জন্ম, কৈশোর ও যৌবনকাল অতিবাহিত করেছেন নীলফামারী শহরে। গ্রামের বাড়ি ইউনিয়নের ব্রহ্মোত্তর গ্রামে হলেও তাকে আমরা কোনদিন চোখ দিয়ে দেখিনি। কথা বলাতো দূরের কথা। এজন্য অমন প্রার্থীকে আমরা ভোট দিব কিভাবে? তাছাড়াও বুলবুল চৌধুরী ভাল হোক, আর মন্দ হোক তাকে আমরা চিনি ও জানি। সেও আমাদের চেনে জানে। তার বাবা মরহুম এনামুল হক চৌধুরী চেয়ারম্যান ছিলেন। ইউনিয়ন আ’লীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন তিনি দীর্ঘদিন। নৌকার প্রার্থী চেয়ে আনারস মার্কার প্রার্থীকেই ভোটাররা কাছের মনে করছেন।
৩নং বাঙ্গালীপুর ইউনিয়নে আ’লীগের প্রার্থী হয়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আ’লীগের সভাপতি ডা. শাহাজাদা সরকার। অবশ্য এ ইউনিয়নে আ’লীগের কোন বিদ্রোহী প্রার্থী নেই। কিন্তু বাড়াভাতে ছাই দিয়েছে ডা. শাহাজাদা সরকারের ভাতিজা শামসুল সরকার। শামসুল সরকার বয়সে তরুণ, দানবীর ও জনহিতৈষী ব্যক্তি হিসাবে ইউনিয়নে রয়েছে তার খ্যাতি। তিনি আনারস মার্কা নিয়ে চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন। এক বাড়িতে দুজন প্রার্থী হওয়ায় ভোটাররাও ভাগাভাগি হয়ে গেছে।
তাছাড়াও ডা. শাহাজাদা সরকার ২০১২ সালে চেয়ারম্যান থাকা সময়ে তার ব্যক্তিগত ব্যবহারের কারণে ভোটারারা তাকে পছন্দের তালিকায় রাখছে না। বিশেষ করে এ ইউনিয়নে মার্কার চেয়ে ব্যক্তি পছন্দটাই প্রাধান্য বেশি পাচ্ছে। কথা হয় এ ইউনিয়নের ভোটার অমলেশ, সুরেশ, তারিকুল, জহির, ফাতেমা, কাজলীর সঙ্গে। তারা বলেন আমরা যখন চাই তখনই শামসুল সরকারকে পাই। আমাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ নানা কাজে শামসুল সরকার সহযোগিতা করে আসছেন। সেজন্য আমাদের পছন্দের তালিকায় শামসুল সরকার রয়েছে।
৪নং বোতলাগাড়ী ইউনিয়নে নৌকার মাঝি হয়েছেন প্রভাষক আব্দুল হাফিজ হাপ্পু। তিনি ইউনিয়ন আ’লীগের সভাপতি। ছিলেন উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। রাজনীতির ব্যাকগ্রাউন্ড তার অত্যন্ত চমৎকার এবং ক্লিন ইমেজের অধিকারী। কিন্তু ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হলেও গ্রামে তার কোন বাড়ি ঘর নেই। জন্ম হয়েছে শহরে। বেড়ে ওঠাও শহরে। সারাদিন জনসংযোগ ও পথসভা শেষে শহরের বাড়িতেই ঘুমান। আর এই সুযোগকে পুরোদমে কাজে লাগিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছে ইউনিয়ন আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান সরকার জুন। জুন যেমন গ্রামে বসবাস করে তেমনি রয়েছে তার ভোটারদের সঙ্গে নাড়ীর টান। জুনের মার্কা ঘোড়া। তাছাড়াও জুন ২০১৮ সালে তার প্রার্থীতার ঘোষণা দিয়ে ভোটের মাঠে শক্ত অবস্থান তৈরী করেছেন। সেখানে তৃণমূলের নৌকার সমর্থকরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জুনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। উপজেলা আ’লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মোখছেদুল মোমিনের আপন জ্যাঠাতো ভাই হাপ্পু। তিনি দিনরাত পরিশ্রম করেও নৌকার পক্ষে ভোটারদের টানতে পারছেন না।
কথা হয় ওই ইউনিয়নের কুদ্দুস, গফুর, জাহের, মালেক, আতিয়ার, জাবেদ ও রমজানের সঙ্গে। তারা জানান জুন তাদের কাছে ভোট শুরুর অনেক আগ থেকেই সমর্থন আদায় করেছেন। আমরাও ওয়াদা করেছি তাকে ভোট দেয়ার জন্য। অথচ নৌকা মার্কার প্রার্থী ভোটের তপশীল ঘোষণার ছয় মাস আগে এসে তার প্রার্থীতা জানান দেয়। বিশেষ করে ইউনিয়নে তার বাড়িঘর পর্যন্ত নেই। তিনি চেয়ারম্যান হলে তার শহরের বাড়িতে যেতে হবে। অথচ জুনকে আমরা পাব হাতের নাগালে। সে কারণে তাদের পছন্দের তালিকায় প্রথমেই জুনের নামেই আছে। তবে একাধিক বিশিষ্টজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান মোখছেদুল মোমিন যদি তার অতি আদরের ছোট ভাই হাপ্পুকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করতে চান, তাহলে এরশাদ ও খালেদা জিয়ার ভোট পোলিং স্টাইল অনুসরণ করতে হবে।
৫নং খাতামধুপুর ইউনিয়নে আ’লীগের সমর্থন নিয়ে নৌকা মার্কার প্রার্থী হয়েছেন হাসিনা বেগম। তবে খাতামধুপুর ইউনিয়নের ভোটের হিসাব নিকাশে দেশের অন্যান্য ইউনিয়নের চেয়ে ভিন্ন। কথা হয় এ ইউনিয়নের ভোটার রমিজ, আলী ইমাম, মজিবর, শুকারু ও তাহেরের সঙ্গে। তারা জানান, এ ইউনিয়নের ভোটার দুই পরিবারের বলয়ের বাইরে অবস্থান নেন না।
এই ইউনিয়নের উত্তরাঞ্চলের ভোটারদের নেতৃত্ব দেন মরহুম আজিজুল চৌধুরীর পরিবার। আর দক্ষিণের ভোটারদের নেতৃত্ব দেন মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মোখলেছুর রহমানের পরিবার। এই দুই পরিবারের প্রার্থীদের মধ্যে প্রার্থী হয় এবং হারজিত হয় তাদের মধ্যেই। এজন্য নৌকা মার্কার প্রার্থীর পক্ষে ভোটারদের কাছে টানা খুবই কঠিন কাজ।
এবারেও দুই পরিবারের দুই প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে ভোটের মাঠে লড়ছেন। আজিজুল চৌধুরীর পরিবার থেকে চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন আনারস মার্কা নিয়ে তার ছেলে জুয়েল চৌধুরী। আর বীরমুক্তিযোদ্ধা মোখলেছুর রহমানের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রার্থী হয়েছেন তার ছোট ছেলে যুবলীগ নেতা মাসুদ রানা পাইলট বাবু। তিনি মোটরসাইকেল মার্কা নিয়ে ভোটের মাঠে জোরালো লড়াই করছেন। সে কারণে এ ইউনিয়নে স্থানীয় নির্বাচনে নৌকা মার্কার প্রার্থী ঠিক কতটি ভোট পাবেন তা ২৬ ডিসেম্বর জানা যাবে।
আগামীনিউজ/ হাসান