চেয়ারম্যান প্রার্থীর হুমকি

নৌকায় ভোট দিলে ছাড়তে হবে দেশ, যেতে হবে ভারত

জিকরুল হক, উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি ডিসেম্বর ১৪, ২০২১, ০৩:১৪ পিএম
চেয়ারম্যান প্রার্থী জুয়েল চৌধুরী। ছবিঃ সংগৃহীত

নীলফামারীঃ জেলার সৈয়দপুরে সংখ্যালঘু ভোটারদের হুমকি দেয়ার অভিযোগ মিলেছে চেয়ারম্যান প্রার্থীর বিরুদ্ধে। ওই চেয়ারম্যান প্রার্থীর নাম জুয়েল চৌধুরী। আগামী ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য ইউপি নির্বাচনে তিনি আনারস মার্কা নিয়ে ভোটের মাঠে রয়েছেন। এই চেয়ারম্যান প্রার্থী সংখ্যালঘু ভোটারদের বলছেন নৌকা মার্কায় ভোট দেয়া হলে হিন্দুদের এ দেশে না, ভারতে যেতে হবে। এমন ঘটনা ঘটেছে উপজেলার খাতামধুপুর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডে।

ওই চেয়ারম্যান প্রার্থীর হুমকি ধামকি ও ভোটারদের শারীরিক নির্যাতনের বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা রিটার্নিং অফিসার বরাবরে চারজন ১২ ডিসেম্বর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

গত ১৩ ডিসেম্বর সোমবার বিকালে সরেজমিনে গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই নজরে আসে। এদিনই কথা হয় মধুপুর গ্রামের হিন্দু পল্লীর অধিবাসী ও ইউপি নির্বাচনে ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য পদের প্রার্থী শ্রী তাপস কুমার মহন্ত দস্যুর সঙ্গে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ভোটের মাত্র ১২ দিন অবশিষ্ট রয়েছে। অথচ আমি আমার প্রার্থীতা জানান দিতে পোস্টার লাগাতে পারছি না। ওই ইউপি সদস্য প্রার্থীর অভিযোগের সত্যতা জানতে হামুরহাটে গিয়ে দেখা যায় গোটা হাট জুড়ে চেয়ারম্যান প্রার্থী জুয়েল চৌধুরীর আনারস মার্কার পোস্টার ছাড়া অন্য কোন প্রার্থীর পোস্টার নেই। এমন অভিযোগ করেছেন ২নং সংরক্ষিত আসনের প্রার্থী (৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ড) শ্রীমতি রুপালি রানী। তিনিও উপজেলা রিটার্নিং অফিসার বরাবরে ঘটনার প্রতিকার চেয়ে অভিযোগ দিয়েছেন।

৫নং ওয়ার্ডের রাখালপাড়ার অধিবাসী জগেশ্বর রায় রিটার্নিং অফিসারকে দেয়া অভিযোগে জানান, আমি নৌকা প্রতীকের নির্বাচন করে আসছি। কিন্তু আনারস মার্কার প্রার্থী জুয়েল চৌধুরীর বড় ভাই হাবিবুর রহমান চৌধুরী হাবলু ও তার ছোট ভাই আলফ্রেড টিটু চৌধুরী ৪০/৫০ জন লোক নিয়ে আমার বাড়িতে গিয়ে হুমকি দিয়ে বলে যে, নৌকা মার্কায় ভোট দিলে এদেশ না, ভারতে যেতে হবে।

৫নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চন্দ্র মহন্ত রিটার্নিং অফিসারকে দেয়া অভিযোগে জানান, গত ৯ ডিসেম্বর রাতে আনারস মার্কার প্রার্থী জুয়েল চৌধুরীর ক্যাডার বাহিনী হামুরহাটে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এসে বলে যে নৌকার ভোট করলে তোমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হবে। আবার পরদিন ১০ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় চেয়ারম্যান প্রার্থী জুয়েল চৌধুরী, হাবিবুর রহমান চৌধুরী হাবলু, বাবুল চৌধুরী, টিটো চৌধুরী, রুবেল ও সোহাগ চৌধুরী এসে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে চায়। হাবলু চৌধুরী দেয় প্রাণনাশের হুমকি এবং জুয়েল চৌধুরী ও টিটো চৌধুরী অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। তারা হুমকি দিয়ে বলে যে, তোর মত আওয়ামী লীগের নেতাকে গায়েব করে দেয়া চুটকির ব্যাপার। এমনই হুমকি দেয়া হয়েছে নৌকা মার্কার সমর্থক নূর নবীকেও।

একইদিন মধুপুর হিন্দু পল্লীতে কথা হয় ৭৫ বছর বয়সি নরেশ চন্দ্র গোস্বামীর সঙ্গে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ৭১ সালে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। আর এই স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে আমাকে করতে চাইছে দেশ ছাড়া। সেইদিন নৌকায় ভোট দিয়ে দেশ শত্রুমুক্ত করেছি। নৌকা মার্কা আমার প্রাণের স্পন্দন। অথচ এই মার্কায় আমি ভোট দিলে আমাকে করা হবে দেশ ছাড়া। এদেশে আমরা বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছি। এদেশে আমার ১৪ গোষ্ঠির নাড়ী পোতা রয়েছে, কিভাবে কেমন করে আমি এদেশ ছেড়ে ভারতে যাব। আগামী ২৬ ডিসেম্বর যদি নৌকায় ভোট দিতে না পারি তাহলে ভারতে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর অন্য কোন পথ খোলা থাকবে না। এজন্য তিনি সংখ্যালঘু ভোটারদের সুরক্ষায় স্থানীয় হামুরহাটে ভোট পর্যন্ত অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের জন্য প্রশাসনের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

হামুরহাটের ব্যবসায়ী মিঠু মহন্ত জানান, আনারস মার্কার প্রার্থী জুয়েল চৌধুরী ও তার ভাই এবং তার ক্যাডার বাহিনী প্রকাশ্যে বলছে আমরা দেশের এলিট ফোর্সসহ প্রশাসনের সকল স্তরের কর্মকর্তাদের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করেছি। সারাদেশে হাসিনার শাসন চললেও খাতামধুপুরে চলবে জুয়েল চৌধুরীর শাসন। এ ইউনিয়নে কারো কিছু করার নেই। এমন অবস্থায় আমরা সংখ্যালঘুরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। সন্ধ্যা হলেই বাড়ির বাইরে যেতে পারি না। অঘোষিত জেলখানায় রয়েছি আমরা।

অভিযোগ বিষয়ে জানতে আনারস মার্কার প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান জুয়েল চৌধুরীর মুঠোফোনে কথা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ মিথ্যা।

৫নং খাতামধুপুর ইউপি নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং অফিসার প্রকৌশলী এমএম আলী রেজা রাজুর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, অভিযোগ পেয়ে ইউএনও এবং উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করি। পরে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে তাদেরকে মৌখিকভাবে ওয়ার্নিং দেয়া হয় এবং অভিযুক্তরা আগামী দিনে এ ধরনের কোন কাজ করবে না বলে জানান।

কথা হয় সৈয়দপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল হাসনাত খানের সঙ্গে। তিনি বলেন বিষয়টি নজরে আছে।

নৌকায় ভোট দিলে সংখ্যালঘুরা দেশছাড়া হবে এমন অভিযোগ বিষয়ে জানতে কথা হয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম হোসাইনের সঙ্গে। তিনি মুঠোফোনে জানান, আমার কাছে সরাসরি অভিযোগ করলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আগামীনিউজ/নাসির