কুষ্টিয়াঃ ১৯৭১ মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া পাক সেনা ও তাদের দোসর রাজাকার কর্তৃক ধর্ষণ, লুটতরাজ, বর্বর নির্যাতন, শোষন, হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে কুমারখালীর বীর সন্তান বিপ্লবী বাঘা যতীনের জন্মভূমিতে জন্ম নেওয়া স্বাধীনতাকামী জনতা, পাক সেনা ও তাদের দোসর রাজাকারদের রুখে দিয়ে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার রক্তিম সবুজ পতাকা।
১৯৭১ সালের ৯ই ডিসেম্বর কুমারখালী মুক্ত দিবস। এই দিনে দেশের বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী জনতার প্রতিরোধ পাক সেনাদের সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানা থেকে পাক বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকারদের সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত করে। কুমারখালীবাসীর কাছে এই দিন গৌরবের ও বিশেষভাবে স্মরণীয়। কুমারখালীকে বেঈমান রাজাকার মুক্ত করতে ৭ই ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করে কুন্ডুপাড়াস্থ রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমন চালায়। সে সময় রাজাকার গোলাম রসূল, ফিরোজ-খুরশিদ, গালিব, সাদীদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক রাজাকার আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনে কুষ্টিয়া থেকে পাকিস্তানী সেনারা কুমারখালী শহরে চলে আসে এবং বিক্ষিপ্ত ভাবে শহরের বিভিন্ন এলাকাতে টানা গুলি ছুঁড়ার মাধ্যমে আতংক তৈরি করে। মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও সে সময় অল্প সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা এবং পর্যাপ্ত পরিমানে অস্ত্র, গুলি না থাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে না জড়িয়ে কৌশলে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে সরে যায়। এর ফলে পাকিস্তানী বাহিনী ও রাজাকাররা কুমারখালী শহরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকায় অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট, অনেক নিরিহ মানুষকে হত্যা করে।
সে দিন রাজাকারদের সাথে যুদ্ধে কুন্ডুপাড়ার ওমর আলী ও তোসাদ্দেক হোসেন ননী মিঞা শহীদ হন। পাকিস্তানী সেনা কর্তৃক শহীদ হন সামসুদ্দিন খাঁ, আব্দুল মজিদ ও আশুতোষ বিশ্বাস মঙ্গল, কাঞ্চন কুন্ডু, সামসুজ্জামান স্বপন, সাইফুদ্দিন বিশ্বাস, আব্দুল আজিজ মোল্লা, শাহাদত আলী, আবু বক্কর সিদ্দিক, আহমেদ আলী বিশ্বাস, আব্দুল গনি খাঁ।
পরের দিন ৮ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ণ শক্তি নিয়ে সংগঠিত হয়ে পুনরায় একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকার ক্যাম্পে হামলা করতে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় অবস্থানে থেকে যুদ্ধে অংশ নেয় মুক্তিযোদ্ধা বারিক খান, আব্দুল রাজ্জাক, রঞ্জু, মকবুল হোসেন, হাবীব, ধীরেন বিশ্বাস, মঞ্জুর রহমান, রেজাউল করিম হান্নান, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গনি, কামাল, মঞ্জু সাত্তার, টগর, সামছুল আলম পিন্টু মাষ্টার, মাহাতাব, আতিয়ার রহমান স্বপন, জহুর, মিজান বিশ্বাস প্রমূখ। ৯ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা শহরের চারপাশ থেকে পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর ক্যাম্পে (যেটা বর্তমানে কুমারখালী উপজেলা পরিষদ) আক্রমন করে।
দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনারা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। এ যুদ্ধে টিকে থাকতে না পেড়ে পাক সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরে এক পর্যায়ে পাক সেনা বাহিনীর সদস্যরা পালিয়ে ট্রেনযোগে কুষ্টিয়ার দিকে যেতে চাইলে তাদের বহনকারী ট্রেনটি চড়াইকোল রেল স্টেশন এবং গড়াই নদীর রেল সেতুর মাঝামাঝি এলাকাতে পৌছাঁনোর সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনটিকে লাইনচ্যুত করে দেয়। ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে গেলে পাক সেনারা ট্রেন থেকে নেমে নিজেদের বাঁচাতে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে হেঁটে কুষ্টিয়া দিকে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা আরেকটি ট্রেন যোগে আবার কুমারখালীতে ফিরে আসার ব্যার্থ চেষ্টা করে।
সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে রাজাকার কমান্ডার খুশি নিহত হয়। আর অন্যান্য সহযোগী রাজাকাররা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। এর মধ্য দিয়েই ৯ ডিসেম্বর কুমারখালী থানা পাক বাহিনী ও রাজাকার মুক্ত হয়। এই দিন মুক্তিযোদ্ধারা শূন্যে রাইফেলের গুলি ফুটিয়ে উল্লাস করতে করতে কুমারখালী থানায় গিয়ে জমায়েত হয়।
এ দিন কুমারখালী শহরের গণমোড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম হান্নানসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা। এই পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে কুমারখালীকে পাক হানাদার মুক্ত ঘোষনা করা হয়। কুমারখালী পাক হানাদার মুক্ত হওয়ার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সকল শ্রেণী পেশার মানুষ কুমারখালী শহরে ছুটে এসে রাস্তায় নেমে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেন।
আগামীনিউজ/নাসির