জাওয়াদের প্রভাবে ঝিনাইদহে ধান ফসলের ব্যাপক ক্ষতি

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঝিনাইদহ ডিসেম্বর ৭, ২০২১, ১১:৩৪ এএম
ছবিঃ সংগৃহীত

ঝিনাইদহঃ ঘূর্নিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে তীব্র বৃষ্টির ফলে জেলায় ধান ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গত দুই দিনের টানা বৃষ্টিতে কৃষি ক্ষেতে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। ফলে মাঠে থাকা পাকা আমন ধানের জমি প্রায় ডুবু ডুবু অবস্থা। ক্ষেতে কেটে রাখা ধান তলিয়ে গেছে। ফলে এই ধান ঝরে চারা গজিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি এভাবে কয়েকদিন থাকলে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা কৃষকদের। অন্যদিকে সরিষা, পেয়াজ ও গমের ক্ষেতেও পানি জমে গেছে। জেলায় মোট আবাদকৃত আমন ধানের প্রায় ২০ ভাগ এখনও জমিতেই রয়ে গেছে। কয়েকদিন ধরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি থাকলেও সোমবার দুপুরের পর শুরু হয় ভারি বর্ষণ, যা বিকাল পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।

জেলায় চলতি মৌসুমে আমন ধান চাষ হয়েছিল ১০৪৬১২ হেক্টর। যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক ধান এখনো মাঠে রয়েছে। এছাড়া সরিষা চাষ হয়েছে ৯১৭১ হেক্টর, পেয়াজ ৭৬১ হেক্টর, গম ৪৩৫৪ হেক্টর এবং ভৃট্রা ১০৮৮৫ হেক্টর।

সরেজমিনে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের বিভিন্ন মাঠে গেলে দেখা যায়,মাঠের পর মাঠে আমন ধান ক্ষেতেই পড়ে ভিজছে। তারমধ্যে কোনটি ক্ষেতে ছড়ানো,কোনটি আটি বাধা,আবার কোনটি না বাধা ধান জমিতে ছড়ানো ছেটানো। এগুলোর ওপর দিয়ে গত ২ দিনে বয়ে যাচ্ছে লাগাতর বৃষ্টি। এর প্রভাবে সব মাঠের ধানক্ষেত এখন পানির নিচে।

কালীগঞ্জ উপজেলার খামারমুন্দিয়া গ্রামের কৃষক দলিল জানান, মাঠের চলতি মৌসুমে তিন বিঘা জমিতে ধান ছিল। প্রায় সব বাড়িতে আনা হয়েছে। বাকি ১০ কাঠা ধান মাঠে ছিল। গত দুই দিনের বৃষ্টিতে সে ধানের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। এখন সে ধান ঝরে চারা গজিয়ে যাচ্ছে। একই ভাবে পানিতে সরিষা ক্ষেতও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে আমাদের চরম লোকসান হবে বলে যোগ করেন।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসসূত্রে জানাগেছে, চলতি আমন মৌসুমে এ উপজেলার ধানচাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৫’শ হেক্টের। কিন্ত চাষ হয়েছে ১৮ হাজার ৭’শ ৫০ হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২’শ ৫০ হেক্টর বেশি জমিতে আমন চাষ হয়েছে। এরমধ্যে মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ জমির ধান কৃষকেরা ঘরে তুলতে পেরেছেন। বাকি ধানের  ১০ ভাগ মত বাড়িতে এনে পালা দিয়ে রেখেছেন আর গুলো ক্ষেতেই পড়ে ভিজছে।

একাধিক কৃষক জানান, চলতি আমন মৌসুমের ধানে কোন ধরনের কীটপতঙ্গের আক্রমন ছিল না। ইতোমধ্যে যে ধানগুলো মাড়াই করা হয়েছে ফলনও হয়েছে লোভনীয়। ফলে ক্ষেতের ধান কৃষকদেরকে স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। কিন্ত পরপর দু'দফায় নিম্নচাপের বৃষ্টিতে কৃষকের আমন ধানে অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে।

এদিকে হরিণাকুন্ডু উপজেলায় পাকা ফসল ভরা মাঠের ধান কাটা নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে কৃষক। পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত সু-ব্যবস্থা না থাকায় ধান ভরা মাঠ থেকে নামছে না পানি। এ অবস্থায় আশায় বুক বাধা কৃষকরা মাঠের পাকা ধান ঘরে তোলা নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। এতে উপজেলার ১৩৫ টি গ্রামে, সরিষা, গম, মশুরি সবজিসহ আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের পর মাঠ,আর মাঠে রয়েছে ধান। এসব ক্ষেত বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে। ক্ষেত থেকে পানি সরানোর জন্য দিনরাত আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কেউবা আবার পানি নিষ্কাশনের জন্য ক্ষেত থেকে লাইন কেটে পাশের খালে কেও বা ক্যানালে সঙ্গে মিলিয়ে দিচ্ছে।

এক কলেজ পড়ুয়া ছাত্র পিয়াস হোসেন জানান, বাবার তলিয়ে যাওয়া ধান সংগ্রহ করতে ছোট ভাইকে নিয়ে মাঠে এসেছে সে। সকাল থেকে হাটু সমান পানিতে হেঁটে হেঁটে বাবার সঙ্গে ধান রাস্তার পাড়ে নিয়ে আসছে পিয়াস। বাবা কয়েকদিন থেকেই মাঠ থেকে ধানগুলো নিয়ে যাব যাব করছে। কিন্তু গরুর গাড়ি না পাওয়ায় নিয়ে যেতে পারছে না।শনিবার গরুর গাড়িতে ধানগুলো বোঝায় করে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা আর হল না।

এ ব্যাপারে ফলসী, শিতলী, ভালকী, জোড়াপুকুরিয়া, বৈঠাপাড়া, কুলবাড়িয়া, কেষ্টপুর, দখলপুর, তাহেরহুদাসহ কয়েকজন কৃষক বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আমন ধানের ফলন ভালো হয়েছে। তবে এসব বিস্তৃত এলাকার পানি নিষ্কাশনের অভাবে এখনো ধানের ক্ষেতগুলোতে হাঁটু সমান পানি জমে থাকায় কাটা ধান ঘরে তুলা যাচ্ছে না। সময় মতো পানি চলে না যাওয়ায় এসব জমিতে মনে হয় সরিষার আবাদও করা যাবে না। এমনকি আগামী বোরো মৌসুমের ইরি-বোরো ধানের চারা উৎপাদনও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। এ অবস্থায় আমরা কি করব বুঝে উঠতে পারছি না।

হরিণাকুন্ডু উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাফিজ হাসান জানান, ১১ হাজার ১ শত’ জমির লক্ষ মাত্রা নিয়ে আমন ধান চাষ হয়েছে ১১ হাজার ২ শত’ জমিতে, বৈরী আবহাওয়ার ফলে উপজেলা কৃষকদের আমন তেমন ক্ষয় ক্ষতি না হলেও কৃষকের প্রস্তুকৃত ধান পড়ে থাকায় কিছুটা ক্ষতি হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রধানত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২০০ শত’৫০ হেক্টর জমির গমের মধ্যে ৮০ হেক্টর জমির গম, ১৪ শত’ ৫০ হেক্টর মসুরী এর মধ্যে ১০০ শত ১২ হেক্টর জমির মসুরী। এছাড়াও ১৫’শত ১০ হেক্টর সরিষার মধ্যে ১৬৬ হেক্টর জমির ফসল।

এদিকে জেলার শৈলকুপায় তিনদিনের টানাবৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেছে খেত। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন উপজেলার কয়েক হাজার চাষি। ফসল রক্ষায় অতিরিক্ত অর্থ খরচ করেও এই বৃষ্টিতে মিলছে না শ্রমিক। ফলে খেতেই পঁচে যাচ্ছে ধান।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, খেতে বৃষ্টির পানিতে ভাসছে কাটা ধান। অনেক খেতে ধান পঁচে গেছে। অন্তত বিচালি (খড়) যাতে পাওয়া যায় সে চেষ্টায় ব্যস্ত কৃষকরা।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর এক বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করতে সবমিলিয়ে খরচ হয়েছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। বর্তমানে শ্রমিক খরচ আরও প্রায় তিন হাজার টাকা বেড়ে ১৫ হাজারে ঠেকছে। গোখাদ্য বা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার্য বিচালি বা খড় পঁচে যাওয়ায় ক্ষতি আরও বেড়েছে।

কৃত্তিনগর গ্রামের কৃষক মতলেব মল্লিক বলেন, সাধারণত এক বিঘা জমিতে ১৮ মণ হারে ফলন হয়। সেখানে বৃষ্টির কারণে পানিতে ডুবে যাওয়ায় আট থেকে ১০ মণের মতো ধান ঝরে যাবে। বিচালিও পঁচে নষ্ট হয়ে গেছে।

কৃষিশ্রমিক আলী বলেন, হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ায় মাঠের কাটা ধানগুলো পানিতে ডুবে গেছে। এখন প্রতি বিঘা জমিতে চার থেকে পাঁচজন শ্রমিক বেশি লাগবে। আগে যেখানে এক বিঘা জমিতে খরচ হতো আড়াই হাজার টাকা, সেখানে এখন অতিরিক্ত খরচ হবে তিন থেকে চার হাজার টাকা। এখনতো বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করার মতো শ্রমিকও পাওয়া যাচ্ছে না।

ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক আজগর আলী জানান, ধান, গম, পেয়াজ, সরিষা ক্ষেতে পানি জমে আছে। তবে এই পানি যদি ৪ থেকে ৫ দিন থাকে তবে লোকসানের পরিমানটা অনেক বেশী হবে। আমরা চেষ্টা করছি কি পরিমান জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তা নিরুপন করার। ক্ষতির পরিমান নির্ধারন শেষে ক্ষতিপুরণের বিষয়ে অথিধদপ্তরকে জানানো হবে।

আগামীনিউজ/বুরহান