বেনাপোল: আগামী ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে ৩য় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শার্শা উপজেলা ও বেনাপোল পোর্ট থানা এলাকায় কিছুতেই থামছে নির্বাচনী সহিংসতা। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, সহিংসতা যেন ততই বাড়ছে।
উপজেলার কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই দেশীয় অস্ত্র, বোমা কিংবা গোলাগুলি নিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এতে করে ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছে গোটা উপজেলা জুড়ে। কখনো নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা আক্রমণ করছে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের। আবার কখনো বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকরা আক্রমণ করছে নৌকা প্রতীকের সমর্থকদের উপর। আক্রমণের উভয় পক্ষের সমর্থকদের হতাহতের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। এতে যেমন ভোটারদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনপার করছে স্থানীয়রা।
প্রার্থী ও ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। প্রার্থীরা চাইছেন নিরপেক্ষ ভোট, অন্যদিকে ভোটাররা চাইছেন তাদের ভোট প্রয়োগের অধিকার।
জানা যায়, শার্শা সদর, উলাশী, বাগআঁচড়া, কায়বা, গোগা, পুটখালী, লক্ষনপুর, ডিহি, নিজামপুর ও বাহাদুরপুর ইউনিয়নের মধ্যে উলাশী, পুটখালী ও গোগা ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই তিনটি ইউনিয়নে প্রায় প্রতিদিনই আওয়ামীলীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে হামলা, পাল্টা হামলা, অফিস ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগসহ ঘটছে বোমা হামলার ঘটনা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেভাবে সংঘর্ষ বেড়ে চলেছে, তাতে করে নির্বাচন আসা পর্যন্ত কি হবে বলা যাচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে শার্শা উপজেলা রণক্ষেত্রে পরিনত হবে। পুলিশ প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে ও কঠোর হস্তে দমন করার আহবান জানান এলাকার সাধারন মানুষ।
নির্বাচনী সহিংসতায় এ পর্যন্ত দুই জন নিহত ও শতাধীক ব্যক্তি আহত হয়েছে। সর্বশেষ ২১ নভেম্বর বেনাপোলের পুটখালীতে নৌকার দুই সমর্থক হযরত আলী (২৯) ও মাহবুব হোসেন (৩০) নামে দুইজনকে কুপিয়ে যখম করে হাসপাতালে পাঠিয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকরা। এর আগে ২০ নভেম্বর শার্শার সাতমাইল এলাকার মোস্তাক ধাবক (৪০) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
গত ১৬ নভেম্বর বাগআঁচড়ার সাতমাইল পশুর হাট থেকে বাড়ি ফেরার পথে বায়তুল মামুর জামে মসজিদ এর সামনে নির্বাচন সহিংসতায় স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল খালেক ধাবক ও নৌকার প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান ইলিয়াছ কবির বকুলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে তিনি আহত হন। একই দিন বেনাপোল পোর্ট থানার পুটখালী ইউনিয়নের মহিষাকুড়া গ্রাম থেকে ১০ বোমা ও বিস্ফোরকসহ স্বতন্ত্র প্রার্থীর ৪ সমর্থককে আটক করে পুলিশ। আটককৃতরা সবাই পুটখালি ইউনিয়নের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী নাসির উদ্দিনের সমর্থক বলে পুলিশ জানান। নৌকা প্রার্থীর সমর্থকদের উপর বোমা হামলার জন্য তারা বোমা বানাচ্ছিল।
আটককৃতরা হলো- আলা হোসেন (২৬), জাহিদ হোসেন (২৩), সজিব হোসেন (২১) ও আজগর আলী (৫৪)। ১৯ নভেম্বর উপজেলার গোগা ইউনিয়নের পাঁচ ভুলোট দাখিল মাদরাসার সামনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আব্দুর রশিদ ও তবিবর রহমান সমর্থকদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় গোগা ইউনিয়নের অগ্রভুলোট এলাকার ফজর আলী (৪০), আশরাফুল ইসলাম (৩০) ও রবিউল ইসলাম (৪০) আহত হন। এ সময় বেশ কিছু দোকানপাট ভাংচুরের ঘটনাও ঘটে। তাদের যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
১৮ নভেম্বর সন্ধ্যার পর বেনাপোল পোর্ট থানার বৃত্তিআঁচড়া গ্রামে নৌকার সমর্থক মোক্তার মেম্বারকে হত্যার উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকরা বোমা নিক্ষেপ করে। মোক্তার মেম্বার জানান, তার নির্বাচনী কার্যালয়ে বসে নেতা-কর্মীদের সাথে আলাপকালে মোটরসাইকেলে এসে তাকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা করা হয়। বোমা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে তিনি বেঁচে যান। পুলিশ হামলাকারীদের দুটি মোটর সাইকেল জব্দ করেন।
১৭ নভেম্বর রাতে উপজেলার উলাশী ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী অফিস ভাংচুরের অভিযোগ উঠে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। একইসঙ্গে সম্বন্ধকাঠি মোড়ের এক মেম্বার প্রার্থীর অফিস ভাংচুরের অভিযোগ উঠে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। উপজেলার উলাশী বাজারে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর কয়েকজন কর্মী আহত হয়েছেন।
১৬ নভেম্বর উপজেলার ডিহি ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পন্ডিতপুর গ্রামে মেম্বার প্রার্থী খানজাহান আলীর সমর্থকরা ভোট চাইতে গেলে আরেক প্রার্থী কামরুজ্জামান জজ মিয়ার দু‘জন সমর্থক তাদের নিষেধ করেন। এতে খানজাহান আলীর সমর্থকরা ক্ষিপ্ত হয়ে তাদেরকে ধাওয়া করেন। দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ২২ জন কর্মী-সমর্থক আহত হয়।
১২ নভেম্বর উপজেলার সীমান্তবর্তী গোগা ইউনিয়নে আলী ফকির (৫২) নামে স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক সমর্থক মারা যায়। আলী ফকির পাঁচভুলাট গ্রামের মৃত ইউছুফ আলীর ছেলে।
নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানান, ২৩ অক্টোবর গোগা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী তবিবর রহমানের মনোনয়ন নিতে তার সমর্থকরা যশোর যান। বাড়ি ফেরার পথে গোগা বাজারে আব্দুর রশিদ চেয়ারম্যানের সমর্থকরা তবিবর রহমানের সমর্থকদের ওপর হামলা চালালে ১২ জন আহত হন। আহত ১২ জনের মধ্যে আলী ফকির চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাড়িতে মারা যায়।
শার্শা উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মেহেদী হাসান জানান, শার্শা উপজেলার মোট ১০টি ইউনিয়নে ভোট হচ্ছে আগামী ২৮ নভেম্বর। তবে ১০টির মধ্যে উলাশী, পুটখালী ও গোগা ইউনিয়নের নির্বাচন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
বেনাপোল পোর্ট থানা পুলিশের ওসি মামুন খান ও শার্শা থানার ওসি বদরুল আলম খান জানান, নির্বাচন নিয়ে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। আমরা শক্তহাতে তা দমন করেছি। সহিংসতার ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য এলাকায় পুলিশ টহল জোরদার করা হয়েছে। এলাকায় অধিক পুলিশ ফোর্স মোতায়ন করা হয়েছে এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। এখানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও নিরপেক্ষ ভোট গ্রহণের জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
আগামীনিউজ/ হাসান