বালিয়াডাঙ্গীতে গরীবের মেহমানখানা

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি: নভেম্বর ২০, ২০২১, ১০:৩১ পিএম
ছবিঃ আগামী নিউজ

ঠাকুরগাঁও: হামরা ভিখারী বারে, একবেলা খাই তো একবেলা না খায়ে থাকি” দিনের খাওয়া যোগার করা হামার তানে কষ্টের, সেইঠে মাছ, মাংস দিয়া পেঁট ভরে ভাত খাবা পারিমো এইটা তো স্বপ্নেও ভাবু নাই মুই। যারা হামাক প্রত্যেক সপ্তাহে এক বেলা গোশভাত খাওয়াছে আল্লাহ ওমার ভালো করিবে”। মেহমান খানায় খেতে খেতে এসব কথা বলছিলেন খদেজা বেওয়া (৬০) নামে এক ভিখারী। ভিক্ষা করে কোনরকম খেয়ে না খেয়ে জীবন কাঁটছে খদেজা বেওয়ার। কোন একজনের কাছে খবর পেয়ে মেহমান খানায় এসেছে দুপুরের খাওয়া খেতে।

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় বাজারের পাশে প্রতি শুক্রবার জুম্মা’র নামাজের পর এই “মেহমান খানা” তে নিরন্ন মানুষদের বিনামূল্যে একবেলা উন্নত মানের খাবার খাওয়ানোর আয়োজন করা হয়। বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ৮ ইউনিয়নসহ পাশ্ববর্তী রাণীশংকৈল ও সদর উপজেলা থেকে প্রতি শুক্রবার এখানে একশ থেকে দেড়শ জন ভিক্ষুক, মানসিক ভারসাম্যহীন, নিম্ন আয়ের মানুষ এখানে একবেলা মাংস ও মাছ দিয়ে ভাত খাচ্ছেন। এ কর্মযজ্ঞে শুরুতে কম মানুষ এলেও দিন দিন মেহমানদের ভিড় বাড়ছে। প্রথমে ৪০/৫০ জন হলেও এখন এখানে দুইশ থেকে আড়াইশ জন নিরন্ন মানুষ বিনামূল্যে পেঁট পুড়ে খাওয়া করে।

স্থানীয় সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিককর্মী হারুন অর রশিদ ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতি শুক্রবার উপজেলার মাছ বাজার সংলগ্ন বিডিও স্যানিটেশন ফার্মের মাঠে এ মেহমান খানার আয়োজন করেন। গত শুক্রবার ২৫০জন এবং এই শুক্রবার (১৯ নভেম্বর)প্রায় ৩শ’ জন নিরন্ন মানুষ এই মেহমান খানায় খেয়েছেন বিনামূল্যে।

শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক সকাল থেকে চেয়ার ও টেবিল সাজাচ্ছেন। বাবুর্চি রান্না করছে। বেলা গড়িয়ে জুম্মার আযান দিলেই মেহমান খানায় শুরু হয় ভিক্ষুক ও নিরন্ন মানুষদের উপস্থিতি। নামাজ শেষে কয়েক দফায় চলে খাওয়া দাওয়া।

মেহমান খানার স্বেচ্ছাসেবকরা জানান, এক দফায় একশ’ জন মানুষ বসে খেতে পারেন। তিন দফায় তিনশ’ জন। আশা করছি আগামী কয়েক সপ্তাহ গেলে ৫ শতাধিক মেহমান পাওয়া যাবে।

জিয়াখোর গ্রামের মনসুর আলী ও ফুলতলা গ্রামের আক্তারুল ইসলাম নামে দুই বাবুর্চি সকাল থেকে ব্যস্ত সময় পার করছেন রান্নার কাজে। তারা জানান, মেহমান খানা চালুর পর থেকে তারা কোন পারিশ্রমিক না নিয়ে রান্না করে দিচ্ছেন । ৮ বছরের বাবুর্চি পেশায় রান্না করে যতটা তৃপ্তি পেয়েছেন। এই সাত সপ্তাহে তার চেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছেন তারা। আগামী সপ্তাহগুলো থেকে শুক্রবার কোন অনুষ্ঠানের রান্নার দায়িত্ব নিবেন না বলেও জানান তারা।

বিরাট এই কর্মযজ্ঞের আয়োজক সাংবাদিক হারুন অর রশিদ জানান, তিনমাস আগের কথা। শুক্রবার দুপুরে এক ভিক্ষুক এসে আমার কাছে খাবার চেয়ে বসে। জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, ৫ জনের বাড়ীতে খাবার চাওয়ার পরও তাঁকে কেউ খাবার দিতে রাজি হয়নি। সেদিন মনস্থির করেছিলাম সপ্তাহে অন্তত একবার এমন নিরন্ন মানুষের জন্য একবেলা খাবার আয়োজন করার। স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে পরামর্শ করে কাজে নেমে পরি।

তিনি জানান, প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে হতভাগা সেন্টার নাম দিয়ে নিরন্ন মানুষদের খাবারের আয়োজন করার ঘোষণা দিয়েছিলাম। আর প্রথম শুক্রবার বাজারে আসা ভিক্ষুক, মানসিক ভারসাম্যহীন ও নিম্ন আয়ের মানুষকে একবেলা খাওয়ার জন্য দাওয়াত দিই। প্রথম সপ্তাহে ১১৫ জন এসেছিল। এরপরে এটির নাম পরিবর্তন করে “মেহমান খানা” রাখা হয়।

কতদিন কার্যক্রম চলবে ? এমন প্রশ্নের জাবাবে হারুন অর রশিদ জানান, আমার ইচ্ছা এটি চলমান থাকবে সারাজীবন। আমি ব্যক্তিগত ব্যয়ে ৬ সপ্তাহ পরিচালনা সম্পন্ন করেছি। ইতোমধ্যে অনেকেই সহযোগিতা করার ইচ্ছা পোষণ করেছেন ও অনেকে সহযোগীতা দিতে শুরু করেছেন। আশা করছি সমাজের বিত্তবান লোকজন এগিয়ে এলে এটি আরও বৃহৎ আকারে করা সম্ভব হবে।

স্থানীয় সংবাদিক মামুনুর রশিদ শুক্রবার মেহমান খানায় কার্যক্রম দেখতে এসে জানান, পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ভিক্ষুক চলে এলে আমরা অনেকে প্রচুর বিরক্তির সহিত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি। কেউ হয়তো উচ্ছিষ্ট কিংবা সামান্য খাবার দিয়ে থাকি। কিন্তু এখানে ওইসব মানুষদের অতিথির মর্যাদায় আপ্যায়ন করা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ ও প্রশংসার দাবিদার।

বালিয়াডাঙ্গী প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাংবাদিক রমজান আলী বলেন, সপ্তাহে ২’শ মানুষকে বিনামূল্যে খাওয়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে শক্ত মনেবলের প্রয়োজন, এতে প্রচুর টাকা খরচ হয়। নিঃসন্দেহে এটি একটি ব্যতিক্রম উদ্যোগ। কার্যক্রমটি চলমান রাখার জন্য সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

আগামীনিউজ/শরিফ