বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর চাপে কোনঠাসা নৌকার মাঝিরা

বেনাপোল প্রতিনিধি নভেম্বর ৯, ২০২১, ০৫:০৯ পিএম
ফাইল ছবি

যশোরঃ জেলার সীমান্তবর্তী শার্শায় জমে উঠেছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। মহড়া, মোটরসাইকেল শো-ডাউন ও নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে সরগরম শার্শা উপজেলা। হোটেল রেস্তোরাঁ, চায়ের দোকানে চলছে নির্বাচনী আলোচনা। উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় কোনঠাসা হয়ে পড়েছে নৌকার প্রার্থীরা। তবে ভোটের দিন যতই এগিয়ে আসছে, জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছে। বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে প্রার্থী না দিলেও আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার প্রার্থীরা সুবিধাজনক স্থানে, এমনটি বলা যাচ্ছে না। এর কারণ, বেশির ভাগ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগেরই নেতাকর্মীরা। এই বিদ্রোহী প্রার্থীরা নৌকার জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। কোথাও কোথাও নৌকার প্রার্থীরাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। ১১ নভেম্বর প্রার্থীতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। এর আগে বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সরে না দাঁড়ালে দল থেকে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা কমিটি।

তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শার্শা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে মনোনায়ন পত্র জমা হয়েছে চেয়ারম্যান ১০টি পদে ৪৯ জন মনোনায়ন পত্র দাখিল করেছেন। এছাড়া ৯০টি সাধারন মেম্বার পদে হিসাবে ৪৫১ জন এবং ৩০টি সংরক্ষিত মহিলা আসনে ৯৭ জন প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে মোট ভোটার ২ লাখ ৩৫ হাজার ২৪৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ১৮ হাজার ২০০ জন ও নারী ১ লাখ ১৭ হাজার ৪৩ জন বলে শার্শা উপজেলা নির্বাচন কমিশনার মেহেদী হাসান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, যশোরের শার্শা উপজেলা আওয়ামী লীগের দুটি গ্রুপ রয়েছে। এর একটি স্থানীয় সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিনের সমর্থক। অপরটি বেনাপোল পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম লিটনের সমর্থক। স্থানীয় সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন ও বেনাপোল পৌর মেয়র আশরাফুল আলম লিটনের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বের কারণে বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের রোষানলে পড়তে হচ্ছে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও সমর্থকদের। ইতোমধ্যে পুটখালি, গোগা ও বাগআঁচড়া ইউনিয়নে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে।

১০টি ইউনিয়নের মধ্যে কায়বা, গোগা, বাগআঁচড়া, নিজামপুর, ডিহি ও বাহাদুরপুর ইউনিয়নের প্রার্থীরা এমপি শেখ আফিল উদ্দিনের সমর্থক। আর পুটখালী, লক্ষণপুর, শার্শা সদর ও উলাশী ইউনিয়নের প্রার্থী মেয়র লিটনের সমর্থক। 

উপজেলার ডিহি ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী আসদুজ্জামান মুকুলের বিপরীতে বর্তমান চেয়ারম্যান আওয়ামীলীগ নেতা হোসেন আলীসহ ১১ জন প্রার্থী মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন। লক্ষনপুর ইউনিয়নে বর্তমানে চেয়ারম্যান ও দলীয় মনোনয়ন পাওয়া আনোয়ারা বেগমের বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগ নেতা শামছুর রহমানসহ ৫ জন মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন। বাহাদুরপুর ইউনিয়নে বর্তমান আওয়ামীলীগের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ও দলীয় নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে গত বছরের বিদ্রোহী প্রার্থী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সম্পাদক মফিজুর রহমানসহ ৫ জন মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন। পুটখালী ইউনিয়নে আওয়ামীলীগের দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল গফফার সরদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে নাসির উদ্দিন মনোনয়পত্র জমা দিয়েছেন। গোগা ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান ও দলীয় মনোনয়ন পাওয়া আব্দুর রশীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী তবিবর রহমানসহ ৩ জন মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন। কায়বা ইউনিনের বর্তমান চেয়ারম্যান ও নৌকা প্রতীকের দলীয় মনোনয়ন পাওয়া হাসান ফিরোজ টিংকুর বিরুদ্ধে গতবারের বিদ্রোহী প্রার্থী আওয়ামীলীগ নেতা আলতাফ হোসেনসহ ৪ জন মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন। বাগআঁচড়া ইউনিয়নে বর্তমান চেয়ারম্যান ও দলীয় মনোনয়ন পাওয়া ইলিয়াছ কবির বকুলের বিরুদ্ধে আব্দুল খালেকসহ ৫ জন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন। উলাশী ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে বর্তমান চেয়ারম্যান ও বিদ্রোহী প্রাথী আয়নাল হকসহ ৪ জন প্রার্থী মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন। শার্শা সদর ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের দলীয় মনোনয়ন পাওয়া কবির উদ্দিন তোতার বিপরীতে বিদ্রোহী প্রাথী হিসাবে বর্তমান চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেনসহ ৩ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। নিজামপুর ইউনিয়নে বর্তমান নৌকা প্রতীকের দলীয় মনোনয়ন পাওয়া আব্দুল ওহাবের বিরুদ্ধে গত বারের নৌকা প্রতীক পাওয়া দলের উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক সেলিম রেজা বিপুলসহ ৭ জন মনোনায়নপত্র জমা দিয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে মেয়র লিটন সমর্থিত নৌকা পাওয়া চার ইউনিয়নেই নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিপক্ষে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। তেমনি এমপি সমর্থিত ৬ ইউনিয়নে ও নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

পুটখালী ইউনিয়নের নৌকার প্রার্থী আব্দুল গফফার সরদার বলেন, আমাদের আজ বিএনপি জামাতের সাথে নির্বাচনের প্রতিযোগিতা নেই। আমাদের একজন শীর্ষ নেতা বিএনপি থেকে কিছু লোক এনে আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে মজা দেখছেন। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নৌকাকে তিনি অবমাননা করছেন। এভাবে চলতে থাকলে আমরা বসে থাকব না। আমরা এসব নেতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবো। এসব মুখোশধারী নেতাদের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের দাবি করবো।

এবারে দলীয় মনোনয়ন না পাওয়া একই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান হাদিউজ্জামান বলেন, আমরা নৌকার বিপক্ষে নই। আমরা সাবেক চেয়ারম্যান গফফার সরদারের বিপক্ষে। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলাম আমি। আমি কোন বিরোধিতা না করে নির্বাচন না করে সরে এসেছি। আমি চাই এ ইউনিয়নে তরুন নেতা নাসির উদ্দিন চেয়ারম্যান হোক। আমরা সন্ত্রাসে বিশ্বাসী নই। আমরা কোন অপরাজনীতিকে প্রশ্রয় দিতে রাজি নই। যারা এর আগে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছে আমরা শুধু তারই বিপক্ষে। 

বাহাদুরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইউনুছ আলী মেম্বর বলেন, এ ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী হিসেবে পর পর ৩ বার বর্তমান চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান নির্বাচিত হলেও এলাকার কোন উন্নয়ন করেনি। তার নিজ গ্রাম ঘিবা আজও অবহেলিত। তিনি কোথাও যান না। তৃর্ণমূলের কোন নেতা-কর্মীর খোজ খবরও রাখেন না। সে কারণে সর্বস্তরের মানুষ স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে মফিজুর রহমানকে সমর্থন দিয়েছেন। এবারের নির্বাচনে আমরা বিপুল ভোটে জয়ী হবো। 

যশোর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বেনাপোল পৌর মেয়র আশরাফুল আলম লিটন বলেন, নৌকা প্রতীক যেখানে, আমি আছি সেখানে। জননেত্রী শেখ হাসিনা যাকে নৌকার মাঝি হিসাবে ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছেন আমরা তাকে বিজয়ী করবো। কোন ভাবেই আমরা নৌকার বিপক্ষে অবস্থান নেব না। আর যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনের পরিকল্পনা করছেন, তাদেরও শুভবুদ্ধি উদয় হবে বলে আমি আশা করি। বিদ্রোহী এসব প্রার্থীরা ১১ নভেম্বরের আগে তাদের প্রার্থীতা বাতিল করে, নৌকার পক্ষে কাজ না করণে বিদ্রোহী  প্রার্থী ও তার পৃষ্টপোষক, সমর্থনকারী নেতা কর্মিদেরকেও আজীবন বহিস্কারের সুপারিশ পাঠানো হবে বলে জানান তিনি।

এদিকে জেলা আওয়ামীলীগের শীর্ষ এক নেতা জানান, আগামী ১১ নভেম্বর প্রার্থীতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। নৌকার বিরুদ্ধে ওই দিনের পর যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে থাকবেন দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের দল থেকে বহিস্কার করা হবে। আমরা একটু অপেক্ষা করছি। কেন্দ্রের থেকে সেরকম নির্দেশনা রয়েছে। 

বিএনপির উপজেলা পর্যায়ের এক নেতা বলেন, এবারের ইউপি নির্বাচনে দলের কোন নেতাকর্মী অংশ নিচ্ছে না। সেই সাথে জামায়াতেরও কেউ অংশ নিচ্ছে না। আওয়ামীলীগের প্রার্থীর তালিকা যে ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিভিন্ন স্থানে নিজেদের মধ্যে সহিংসতা ঘটাচ্ছে তাতে নির্বাচন না করাই ভাল। বিএনপি জামায়াত যৌথ ভাবে নির্বাচন করলে নৌকা প্রাথীদের জমানত বাজেয়াপ্ত হতো বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

আগামীনিউজ/নাসির