শীঘ্রই শুরু হচ্ছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন কাজ

ডেস্ক রিপোর্ট অক্টোবর ৩১, ২০২১, ০৫:০১ পিএম
প্রতিকি ছবি

লালমনিরহাটঃ চলতি বছরের শুস্কমৌসুমে শুরু হতে যাচ্ছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন কাজ। প্রাথমিক অবস্থায় ভারত হতে তিস্তা যেখানে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সেই স্থান থেকে ১৬ কিলোমিটার নদীতে বাইপাস করে পানি দেশের উত্তরের ছোট-বড় নদী-নালা, খাল- বিলে প্রত্যাহার করা হবে। আর এ ১৬ কিলোমিটারের কাজ শুরু হবে নিজস্ব অর্থায়নে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালকের দপ্তর সূত্রে এমনটাই নিশ্চিত করেছে।

সূত্রটি জানায়,  পানি প্রত্যাহারের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে সাময়িক সময়ের জন্য। তিস্তা মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ হলে পুনরায় নদীর পানি তিস্তার মূলচ্যানেলে প্রবাহ সৃষ্টি করা হবে। এই বিকল্প পানি প্রত্যাহার সিষ্টেম করার কারণ হচ্ছে তিস্তার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরুর পর প্রকল্প বাস্তবায়নে ৫ বছর সময় লাগবে। এই ৫ বছরের মধ্যে যদি ভারতের গজলডোবা ব্যারেজ হতে কোন কারণে অতিরিক্ত পানি প্রত্যাহার করে তিস্তা দিয়ে। তাহলে হরকা প্রবাহ সৃষ্টি হয়ে ফ্লাড ফ্লাস হয়ে যাবে। এতে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। ভারত বর্ষা মৌসুমে হরহামেশাই তিস্তা নদীতে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে থাকে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে এটাই প্রধান অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছে।

সূত্রটি আরও জানায়, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকার পৃথক। তাই এই দুইটি রাজনৈতিক আদর্শগত কারণে অভ্যন্তরিক রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াই রয়েছে। এই ক্ষমতার লড়াইয়ে তিস্তা পানি চুক্তি বারবার বিলম্বিত হয়ে আসছে। তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকার আর ঝুঁলে থাকতে চায় না।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালকের দপ্তরে গত বৃহস্পতিবার উত্তরের জেলাগুলোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীগণের সাথে জরুরি বৈঠক হয়েছে। এই বৈঠকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়।

তিস্তা মহাপরিকল্পনায় প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার ২১০ কোটি টাকা। ওই টাকার মধ্যে সরকারি একটা অংশ আছে, বাকিটা প্রকল্প সাহায্য হিসাবে বন্ধুপ্রতিম সকল রাষ্ট্রের কাছে পত্র দিয়ে অর্থ বিনোয়োগ আহবান করেছে সরকার। অনেক কয়টি দাতা সংস্থা সহায়তা করতে আগ্রহী রয়েছে। যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তখন সেই অর্থ দিয়ে কাজ করা হবে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে উত্তরাঞ্চলের স্থায়ী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন হবে। নদী ভাঙন, বন্যায় প্রতিবছর কয়েক শত কোটি টাকা অপচয় রোধ হবে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ছোট ছোট নদী গুলোকে সংযুক্ত করা হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে উত্তরাঞ্চলের ছোট ছোট নদীগুলো খনন করা হয়েছে। এই নদীগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ড্রেনেজ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে গত বছরসহ পরপর পাঁচটি বন্যা আঘাত হানলেও এ অঞ্চলে বন্যার পানির উচ্চতা বাড়তে পারেনি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রমে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ অনেকটা কম হয়েছে বলে দাবি পানি উন্নয়ন বোর্ডের। গত ২০ ও ২১ অক্টোবর তিস্তায় হরকা বন্যা হওয়ায় এই জনপদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেই ক্ষতি নিরুপণের কাজ শেষ হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব বাধ পুরোনো নকশা অনুযায়ী শিগগিরই মেরামত করে দেয়া হবে বলে জানানো হয়।

এদিকে, গত ২৪ অক্টোবর তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে উচুঁ পর্যায়ের টিম মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন করেছে। এই টিমে উপস্থিত ছিলেন- বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পশ্চিমাঞ্চল) এ,কে এম সামছুল আলম, নকশা ও গবেষণা বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. এনায়েত উল্লাহ, উত্তরাঞ্চল রংপুরের প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ, পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুর সার্কেল-২ এর তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী মো. মাহবুবর রহমান, পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আসফাউদদৌলা সহ নীলফামারী ও ডালিয়া ডিভিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ। এই তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পটি লালমনিরহাট জেলায় হলেও সুবিধা ভুগি এই জেলা নয়। বরং লালমনিরহাট জেলা তিস্তার বিরুপ বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুর ডিভিশন সূত্রে জানা যায়, চলতি অক্টোবর মাসের আকস্মিক উজানের পানির হালকা বন্যায় তিস্তা ব্যারাজের ফ্লাড বাইপাসসহ কমান্ড এলাকার দশটি স্থানে ৯৮০ মিটার বাধ ধ্বসে গেছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ কোটি টাকা। উজানের আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে গত বুধবার (২০ অক্টোবর) তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ছিল। পানির চাপে তিস্তা ব্যারেজের ফ্লাড বাইপাস সড়ক খুলে যায়। এতে করে ওই ফ্লাডবাইপাসের ৩০০ মিটারসহ ব্যারাজের উজান ও ভাটির বিভিন্ন স্থানে ৯৮০ মিটার বাধ বিধ্বস্ত হয় গেছে। এর মধ্যে ব্যারাজের উজানে কালিগঞ্জ গ্রোয়েন বাধের ১০০ মিটার, ছোটখাতা টি-গ্রোয়েন বাধের ১০০ মিটার, তিস্তা বাজার স্পার বাধের ৫০ মিটার, ভাটিতে ভেন্ডাবাড়ী স্পার বাধের ৫০ মিটার, ভাবনচুন স্পার বাধের ৫০ মিটার, তিস্তা ডানতীর বাধ ৮০ মিটার, ডাউয়াবাড়ী তিস্তার ডানতীর বাধ ১০০ মিটার, শৌলমারী বাধের ৫০ মিটার, বালাপাড়া কৈমারী স্পার বাধে ১০০ মিটার রয়েছে।

উত্তরাঞ্চল রংপুরের প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ জানান, গত বুধবারের আকস্মিক ওই বন্যা অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এই বন্যায় পানি উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি এবং অন্যান্য স্থাপনাসহ সর্বমোট ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বন্যার তোড়ে ঘর- বাড়ি, গবাদি পশু গৃহস্থালি সম্পদ ভেসে গেছে। কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পলি যুক্ত কৃষি জমি নদীর বালুর আস্তরণ পড়ে বালুর নিচে চাপা পড়ে গেছে। প্রতিবছর তিস্তা নদীতে প্রায় ৬০ লাখ টন উজান হতে বালু, ছোট কংক্রিট ও নুড়ি পাথর ভেসে এসে নদীর তলদেশ ভরাট করে দিচ্ছে। নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক ফজলুর রশিদ জানান, তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্দান্ত সাহসী পদক্ষেপ। এটা বাস্তবায়ন হলে উত্তরের ৮ জেলায় স্থায়ী সমৃদ্ধি আসবে। উত্তরবঙ্গের আর্থসামাজিক দুরবস্থা ঘুরে দাঁড়াবে। মরু প্রক্রিয়া হাত হতে দেশের উত্তরাঞ্চল রক্ষা পাবে। তিস্তা মহা পরিকল্পনা ৫ বছরে দৃশ্যমান হবে। এই পরিকল্পনায় প্রায় ১২ লাখ কৃষি জমি তিস্তা নদী গর্ভে হতে উদ্বার হবে। ১৩৫ কিঃমিঃ নদী গভীর করে খনন করে মূলস্রোতধারা ফিরিয়ে আনা হবে। নদীর প্রসস্থ হবে মাত্র দুই কিঃমিঃ। মূল নদীর সাথে ছোট ছোট চ্যানেল সৃস্টি করে পুনরায় নদীর মূল স্রোতেই প্রবাহিত করা হবে। দুই পাড়ে স্যাটেলাইট শহর গড়ে তুলা হবে। দুইধারে থাকবে রিভার ড্রাইভ সড়ক। হোটেল, মোটেল, শিল্প কলকারখানা, ইকোনমি জোন। শিল্প মন্ত্রনালয় সূত্রে জানা গেছে জাপানের কয়েকটি ভারি ও মাঝারি শিল্প কলকারখানা এখানে স্থাপন হবে। এসব কারখানা জাপান সরকার চীন হতে সরিয়ে বাংলাদেশে স্থাপন করবে। জাপান সরকার এই সব কারখানা হস্তান্তরে ২১ হাজার কোটি মিলিয়ন ডলার চীনকে দিবে।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে মিডিয়ায় নানা অপপ্রচার হয়েছে। চীনের সাথে ভারতের রাজনৈতিক বৈরীতার সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশকে চীনের সাথে জড়িয়ে মিথ্যা অপপ্রচার চালানোর চেষ্টা করে ছিল। যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে সম্পর্কে চিরধরা। দেশ বিরোধীদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিশ্লেষকদের মতে চীন ভারত উন্নয়ন সম্পর্ক ভাগ অবস্থানে রয়েছে। ভারতের রেলওয়ে আধুনিকায়নে চীনের প্রকৌশলগত ও আর্থিক বড় বিনিয়োগ রয়েছে। মিয়ারমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন ভারত ঐক্যবদ্ধ হয়ে মিয়ারমারের সাথে কাজ করছে। বাংলাদেশের সাথে চীন সরকারের উন্নয়ন সম্পর্ক বহু পুরনো। চীন বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে ভারত সরকারের কোন সমস্যা নেই। সমস্যা তথা কথিত মিডিয়ার সৃষ্টি। এই সব মিডিয়ার তেমন কোন ভিত্তি নেই। বাংলাদেশ, ভারত ও চীন ত্রিদেশীয় উন্নয়ন অংশিদার। তিস্তা মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে স্থায়ী ভাবে তিস্তা নদী পাড়ের এক লাখ তের হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা পাবে। সেই সাথে প্রতি বছর ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হবে।

আগামীনিউজ/শরিফ