নারায়নগঞ্জঃ মাছের অবাধ বিচরনের জন্য বিশাল জলরাশি আবাসস্থল হিসেবে প্রয়োজন। খাল বিল, পুকুর, ডোবা নালা, হাওড় বাওড়, নদী এবং বর্ষায় উন্মুক্ত জলাশয়ই মাছের আবাসস্থল। শুকনো মৌসুমে কৃষি জমিতে আবাদ করে মানুষের খাদ্যের সংস্থান করে যে জমি, তা ই আবার বর্ষায় মাছের আবাসস্থল, বিচরন ক্ষেত্র, প্রজনন ক্ষেত্র। আবাসস্থল না থাকলে মাছের উৎপাদক ব্যাহত হবে। প্রোটিনের সংস্থান কমে যাবে। এক শ্রেণির আবাসণ ব্যবসায়িরা মাছের আবাসস্থল, কৃষিজমি বালি দিয়ে ভরাট করে ফেলছে। এতে মাছের সঙ্কটের পাশাপাশি মানুষ ও গো-খাদ্যের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এসব বিষয় চিন্তা না করেই হাউজিং কোম্পানীগুলো কৃষি জমিসহ মাছের আবাসস্থল জলাশয়গুলো ভরাট করে ফেলছে। স্থানীয় ভোক্তভুগিরা সরকারের উচ্চ মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করছে।
মিঠা পানির মাছের অন্যতম উৎস খাল বিলগুলো অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। কিন্তু বালিতে জলাশয় ভরাট হয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। এমনকি মাছের আবাসস্থলও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ৪৬ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য অবৈধভাবে বালি ভরাট, কীটনাশকের ব্যবহার, অবাধে মৎস্য নিধন, কলকারখানার বিষাক্ত পানিতে খাল বিল নদী, হাওর ও জলাশয়ে মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছে।
মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, বিদ্যমান জনবল কাঠামোর আকার বৃদ্ধি, উল্লেখিত সমস্যাগুলোর সঠিক সমাধান হলে রূপগঞ্জে মাছের উৎপাদন আরো কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। তারা বলেন, বিশেষ করে রূপগঞ্জে একটি মৎস্য গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা জরুরি। উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা ইমরান হোসেন বলেন, প্রায় বিলুপ্ত কিছু মাছ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, রূপগঞ্জে ১৩ হাজার ৫৫৬ হেক্টর হাওর, বিল ও জলাশয় রয়েছে। ২০১৮ সালে রূপগঞ্জে মাছের উত্পাদন ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার ৬২৭ মে. টন। চাহিদা ২ লাখ ১৪ হাজার ৭৭৩ মে. টন। এই হিসাবে উদ্বৃত্ত ৫৫ হাজার ৮৫৩ দশমিক ৭০ টন। ‘৮০ দশকেও বিভিন্ন বিলে ঝিলে মাছ কিলবিল করত।
নৌকায় চলার পথে মাছ গায়ের ওপর এসে পড়ত,’ মন্তব্য করে মৎস্য শিকারী নুরা মিয়া বলেন, ‘ খালে বিলে, হাওড়ে বাওড়ে লুট-পাট বন্ধ করে পরিকল্পিত উপায়ে মাছ চাষ ও অভয়াশ্রমগুলোকে নিরাপদ করলে, এগুলোই হতে পারে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের টার্নিং পয়েন্ট।’
ইমরান হোসেন বলেন, ‘পুকুর, বদ্ধ জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বাড়লেও খালে বিলে প্রাকৃতিক ভাবে সেভাবে বাড়ছে না। তবে যথাযথ উদ্যোগ-বাস্তবায়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধি হলে এ অঞ্চলে মাছের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
সূত্র জানায়, ২০১১ সাল থেকে বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে একটি প্রকল্প হাতে নেয় মৎস্য অধিদপ্তর। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির মাছ চাষ, প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাও একই লক্ষ্যে এলাকায় কাজ করছে।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ নিধন, সেচের মাধ্যমে মৎস্য আরোহন, জলাশয়ে যত্রতত্র বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি, জলবায়ুর পরিবর্তন, অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহারসহ নানা কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।
জেলা মৎস্য অফিস সুত্রে জানা যায়, বছরে মাছের চাহিদা ৭২ হাজার ৯১২ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয় ৭৫ হাজার ৪২৭ মেট্রিক টন। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন ২ হাজার ৫১৫ মেট্রিক টন বেশি। তিনি আরো জানান, এ অঞ্চলে হাওর-জলাশয়ের সংখ্যা অনেক কম। পরিকল্পিত উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা গেলে মাছের উৎপাদন আরো বাড়ানো সম্ভব। তিনি জানান, দেশে ২৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছের মধ্যে ৮০ থেকে ৯০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। তবে, প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট এবং বিভিন্ন ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে দিন দিন এ অঞ্চলে মাছের উত্পাদন কমে যাচ্ছে এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মাছ বিলুপ্ত হতে চলেছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ নুশরাত জাহান বলেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য আবাসনের যেমন প্রয়োজন আছে। তেমনি জনগনের জন্যই মাছের দরকারও আছে। মাছের আবাসস্থল নষ্ট করা যাবে না। জলাশয়ও ভরাট করা যাবে না। এ বিষয়ে প্রধান মন্ত্রীর কড়া নিষেধ রয়েছে।
আগামীনিউজ/নাসির