শেখ হাসিনার আমলে সহিংসতার শিকার হয়নি বীরগঞ্জের আদিবাসীরা

জিকরুল হক, উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি আগস্ট ২৮, ২০২১, ০১:০৪ পিএম
ছবিঃ আগামী নিউজ

দিনাজপুরঃ আদিবাসীদের হৃদয় থেকে সহিংসতার আতংক কাটতে শুরু করেছে। তবে পুরোপুরি আতংক কবে নাগাদ কেটে যাবে এমন প্রতিক্রিয়া তাদের অবয়বে ফুটে উঠছে না।

শুক্রবার ২৭ আগস্ট দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার আদিবাসী পল্লী বাগিরাপাড়া গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে সেখানে কথা হয় শান্তি কিসকু, তালাবাবু কিসকু, কবিরাজ কিসকু, ডাবলু কিসকু, মধু কিসকু, শম্পা সরেন ও দিনা কিসকুর সঙ্গে।

তারা জানান, আগে তাদের পল্লীতে সহিংসতার ঘটনা ঘটতো।শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তারা কোন ধরনের সহিংসতার শিকার হয়নি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শুরু করেছে তারা। তবে তাদের মুখায়বে আতংকের চিহ্ন রয়ে গেছে। পুরোপুরি আতংক কবে শেষ হবে তা তাদের হৃদয়েই থাকছে।

বৃদ্ধা শান্তি কিসকু বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো। দেশ স্বাধীনের পর ভিটায় ফিরে আসে। তাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশি সেই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। বিনিময়ে পেয়েছে তারা নিজ স্বাধীন দেশ। কিন্তু স্বাধীনত্তোরকালে নিজ দেশেও পরাধীনতার জালে দীর্ঘদিন আটকা পড়েছিলো। নিজ ভূমিতে হয়েছিলো পরবাসী। সময়ের পরিবর্তনে ও সমাজের গতিশীলতায় পরিবর্তনের হাওয়া আদিবাসী সমাজেও ছাপ ফেলেছে। তাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। লেখাপড়া শিখছে। শিক্ষা উপ-বৃত্তিও মিলছে তাদের। অন্য ধর্মের সহপাঠিদের সঙ্গে গড়ে উঠছে জম্পেশ ভাব।

উচ্চ শিক্ষিতরা চাকরি-বাকরিও করছে। বয়স্ক, বিধবা ভাতাও পাচ্ছে। খাদ্যাভাসে এসেছে পরিবর্তন। কিন্তু তাদের পিছু ছাড়ছে না মজুরি বৈষম্য। আদিবাসীদের ৯৫ ভাগ মানুষের আয়ের উৎস ক্ষেতমজুরি করা। কর্ম উপযোগী নারী-পুরুষ সবাই কৃষিখাতে শ্রম বিক্রি করে। ভিন্ন ধর্মের মানুষের জমিতেই তাদের কাজ করতে হয় বেশি। ভিটেমাটি ছাড়া চাষাবাদের তেমন নিজস্ব জমি নেই তাদের। জীবন বাঁচাতে অন্যের জমিতে মজুরি খাটতে হয়। সারাদিন কাজ শেষে ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা মজুরি মেলে। অথচ অন্য ধর্মের মানুষরা কাজ করে সেখানে দিন শেষে মজুরি পায় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। কিন্তু তাদের মজুরি কোন সময় ৫০ টাকা, কোন সময় ১০০ টাকা। দ্রব্যমূল্যের এই বাজারে ওই টাকা দিয়ে একবেলাও চলা সম্ভব না।

সেকারনে তারা আধাপেটা খেয়ে কোনরকমে জীবন ধারণ করছে। অনেকে বাড়িতে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করে বাড়তি কিছু আয় করে বেঁচে থাকার চেষ্টায় রত। তাদের মতে আদিবাসীরা অত্যন্ত আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন। না খেয়ে থাকবে কিন্তু কারো কাছে হাত পাতবে না। শ্রমের বিনিময়ে যা পাবে সেটা দিয়েই তাদের বেঁচে থাকার অবিরাম চেষ্টা। এ জন্য তারা কোন ত্রাণ পায় না। উপায়ন্তর না পেয়ে কেউ জনপ্রতিনিধিদের স্মরণাপন্ন হলেও তাদের করা হয় অসম্মানিত। দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলায় কমপক্ষে ৫০টি ছোট-বড় আদিবাসী পল্লী আছে। এসব পল্লীতে প্রায় ৫ হাজার আদিবাসী নারী-পুরুষের বাস।

আদিবাসীদের অনেকেই অভিযোগ করে বলেন শেখ হাসিনার আমলের আগে অনেক প্রভাবশালী তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন জমি সুকৌশলে হাতিয়ে নিয়েছে। ভাষার মিল না থাকায় প্রভাবশালীরা এমন সুযোগের সদব্যবহার করেছে। বর্তমানে সেই সুযোগ ক্ষীণ হয়ে আসছে। বাংলা ভাষায় তাদের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া শিখছে। বৃদ্ধা শান্তি কিসমু বলেন আমরা যে মাতৃভাষায় কথা বলি সেই ভাষা স্থানীয় মানুষরা বোঝেন না কিংবা বুঝার চেষ্টাও করে না। আমরা যা বলি তার উল্টোটা তারা হয়তো বুঝে।

সে কারণে আমরা জমি-জিরাত বেঁচতে গিয়ে ভূ-সম্পদ হারিয়েছি। কোন আদিবাসী কারো কুশলাদি মাতৃভাষায় বললে তারা বলে আম চিলকা মেনা মিয়া অর্থাৎ আপনি কেমন আছেন। দাকাইনজোমা মানে ভাত খাবো, আমি হাটে যাবে এটি আদিবাসীদের ভাষায় বলা হয় হাটিয়েন চালা। বয়স্ক আদিবাসীরা মাতৃভাষায় কথা বলতে বেশি পছন্দ করে। অক্ষর জ্ঞানহীন থাকা ও বাংলা ভাষা ঠিকভাবে বুঝতে না পারার কারণে তারা নানাভাবে অফিস আদালতে হয়েছে হয়রানির শিকার। বর্তমানে তাদের সেই অন্ধকার কাটতে শুরু করেছে। আলোর ঝলকানি দেখছে তারা চোখেমুখে।

আদিবাসীরা সরকারি ত্রাণ হতে বঞ্চিত থাকছে এমন অভিযোগ বিষয়ে কথা হয় বীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আব্দুল কাদেরের সঙ্গে। তিনি মুঠোফোনে আগামী নিউজকে বলেন বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।