বরিশালঃ সদর উপজেলা পরিষদ চত্বরে ব্যানার অপসারণকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, হামলা ও গোলাগুলির ঘটনায় পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়েছেন সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মনিবুর রহমান।
বুধবার (১৮ আগস্ট) দিবাগত রাত সাড়ে ১০টার ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে বক্তব্য তুলে ধরেন মেয়র ও ইউএনও।
ঘটনার বিবরণে মেয়র বলেন, যে কাজ করতে গিয়ে আজকের এ ঘটনা, ওই কাজটি আমাদের রেগুলার কাজ। গত মঙ্গলবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে ব্যানার সরানো নিয়ে স্টেটমেন্ট দিয়েছিলাম। সেই ধারাবাহিকতায় থানা কাউন্সিলরের ভেতরে গিয়েসিটি করপোরেশনের লোকজন কাজ করছিল সেটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বাসা না। ওখানে পুকুর আছে, যেখানে সাধারণ মানুষ গোসল করে, ওখানে মসজিদ আছে, ওখানে আরও অনেক অফিস আছে, ওখান থেকে পেছনে বসবাসকারী মানুষদের যাতায়াতের রাস্তাও রয়েছে।
তিনি বলেন, ওখানে কাজ প্রায় শেষের পথে ছিল, পরিষ্কার করে চলে আসবে তখন ইউএনও সাহেব বের হয়ে সিটি করপোরেশনের কর্মীদের বলেছে কার কাছে জিজ্ঞাসা করে সেখানে তারা গিয়েছে। কর্মীরা বলেছে, তাদের গালাগালি করা হয়েছে। আর এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওনার বাসায় হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু ওনার বাসার গেটের ভেতরে কি তারা ঢুকেছে। ওখানে আমাদের ১ নম্বর যুগ্ম সম্পাদক ছিল, তারপর প্রচার সম্পাদকের সঙ্গে সিনিয়রদের পাঠালাম সেখানে কি হয়েছে দেখার জন্য। যখন তারা আমাকে বললো যে গুলি হচ্ছে তখন আমি তাৎক্ষণিক একাই ঘটনাস্থলে চলে গেলাম। আমি যখন ঘটনাস্থলে গিয়ে হেলমেট খুলে কর্মীদের বললাম তোমরা গেটের বাইরেই দাঁড়াও কেউ ভেতরে যেও না। এরপর একা থানা কাউন্সিলের গেট দিয়ে যখন ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম এবং বললাম আমি বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র। তারা সে কথা শুনে অনবরত গুলি করা শুরু করল। এরমধ্যে পেছনে যে নেতাকর্মীরা ছিল, তারা সকলে এসে মানবপ্রাচীর বানিয়ে আমাকে বাহিরে নিয়ে আসল। তারপর থেকে আমার খুবই খারাপ লাগছে, খুবই লজ্জা লাগছে। তাই আমি ওখান থেকে চলে আসছি। চলে আসার পরে শুনলাম আবারও গুলি হয়েছে। আমাদের প্যানেল মেয়র গাজী নঈমুল হোসেন লিটুকে রেখে আসছিলাম যাতে ওখানে অপ্রীতিকর কিছু না ঘটে।
তিনি আরো বলেন, আমি গুলিবিদ্ধ হয়নি, তবে আমাকে গুলি করা হয়েছে। আমার জ্যাকেটের কারণে শরীরের ভেতরে লাগেনি কিন্তু গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছি।
এ সময় তিনি ঘটনার জোড়ালো তদন্ত দাবি করে বলেন, আমরা আইনের আশ্রয় নেব। মেয়র হিসেবে এভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব না। আমি মেয়র হিসেবে তাহলে ব্যর্থ। প্রধানমন্ত্রী আমাকে শপথ পড়িয়েছেন, আমার বাবা আছেন তারা সিদ্ধান্ত নেবেন। যদি আমার অপরাধ হয়ে থাকে, আমি আমার অব্যাহতিপত্র দিয়ে দেব।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ১৫-২০ জনের একটি দল মোটরসাইকেল নিয়ে আমাদের অফিস কম্পাউন্ডের পাশে ঘোরাঘুরি করছিল। তখন আনসার সদস্যরা আমাকে জানায়, বেশকিছু ছেলে-পেলে আমাদের কম্পাউন্ডে প্রবেশ করেছে। এটা সিকিউর এলাকা, তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা এটা বলেছে। তখন তাদের আমি চলে যেতে বলার জন্য আনসার সদস্যদের বলি। এরপরপরই জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পরিচয় দিয়ে রাজীব নামে এক ব্যক্তি কারও অনুমতি না নিয়ে আমার বাসভবনের ভেতরে প্রবেশ করে। আমি নিচে নামার আগেই তাদের ঘরের দরজার সামনে দেখতে পাই।
মুনিবুর রহমান আরও বলেন, ‘তার পরিচয় দেওয়ার পর আমি বললাম এত রাতে কি কারণে এখানে এসেছেন। তখন সে জানায় নির্দেশনা রয়েছে তাই তারা ব্যানার ছিঁড়ছে। তখন আমি বললাম এটা সরকারি কম্পাউন্ড, এখানে সরকারি অফিস-আদালত রয়েছে, আমরা সরকারি অফিসাররা এখানে থাকি। আর এত রাতে এখানে এগুলো শোভনীয় নয়, কাইন্ডলি আপনারা চলে যান, কালকে যেটা করার করবেন। পার্টির যা সিদ্ধান্ত সেটা পরে বাস্তবায়ন করার অনুরোধ জানালেও সে বের হয়ে যাচ্ছে না, তো যাচ্ছে না। পরে আমি দাঁড়িয়ে থেকে তারা চলে গেলে মেইন গেট আনসার সদস্যদের সহায়তায় আটকে দেই।’
পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ৬০-৭০ জন লোক এখানে আসে। আনসার সদস্যরা ভয়ে দৌড়ে উপরে উঠে এসে আমাকে জানায়, স্যার আপনার বাংলোর মধ্যে ৬০-৭০ জন ঢুকতাছে। তারা যখন আমার বাংলোর সামনে তখন আমি ঘর থেকে বের হয়েছি। তখন একজন আমাকে পরিচয় দিলেন বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহামুদ হাসান বাবু। তার পাশে বহু লোকজন, সেখান থেকে একজন খুব উচ্চস্বরে আমার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের নাম ধরে গালিগালাজ করছিল। তখন আমি তার কাছে জানতে চেয়েছি ভাই আপনার পরিচয়টা। তিনি তখন তার নাম সাজ্জাদ সেরনিয়াবাত বলে জানায় এবং বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি হিসেবে দাবি করেন। এসময় তার পাশ থেকে একজন বলছিল— তুই পরিচয় দিয়ে কি করবি?’
একসময় কথা বলতে বলতে যখন আমার পেছন দিকে লোকজন আসতে শুরু করে, তখন আমি বুঝতে পেরেছি যে আমাকে ঘিরে ধরা হচ্ছে। তখন আনসার সদস্যদের ইশারা দিলে তারা আমার কাছে চলে আসে। আনসাররা বাঁশি বাজালেও যখন তারা সরছিল না তখন আনসার সদস্যরা ফোর্স করছে। তখন যে যার মতো করে দৌড় দেয়। আর তখন আমি নিজে মাহামুদ হাসান বাবুর হাত ধরে ফেলেছিলাম এবং আনসারের হাতে তুলে দেই। তাদের বের করে দিয়ে আমাদের গেট আটকে দিয়েছি। তারপরে দুইশ, তিনশ, চারশ না পাঁচশ আমি জানি না, বহু লোক এসে আমাদের সরকারি গেটটাকে ভেঙে তচনছ করে ভেতর থেকে ঢুকে আমার ঘরের বারান্দা পর্যন্ত চলে আসে। ভাগ্যিস আমার উপজেলার অফিসাররা চলে এসে তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা আটকে উপরে নিয়ে যায়। কারণ ওরা নীচতলায় ঘরের ভেতর পর্যন্ত চলে এসেছিল। যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্য দিয়ে না গেলে বোঝা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, আমার পক্ষ থেকে গুলি করার অর্ডার (ডেসপাসের অর্ডার) দেওয়া হয়নি, তবে আমার বাসার সামনে যখন আমাকে ঘিরে ধরা হবে তখন আনসার সদস্যরা তো আমাকে সেভ করার চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক।
তবে ইউএনও’র এমন কাণ্ডকে ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে দাবি করেছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাস।