রূপগঞ্জে অগ্নিকান্ড: সরকারি সংস্থা ও মালিকপক্ষের গাফিলতিতেই প্রাণহানি

নজরুল ইসলাম, রূপগঞ্জ (নারায়নগঞ্জ) প্রতিনিধি আগস্ট ৯, ২০২১, ১১:৫০ এএম
ফাইল ফটো

নারায়নগঞ্জঃ জেলার রূপগঞ্জে হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানি (সেজান জুস) কারখানায় আগুনের ঘটনায় জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন দাখিল করেছে। প্রতিবেদনে কারখানার মালিকের অনিয়মসহ সরকারি সংস্থার গাফিলতির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।

কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রম অধিদপ্তর এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেনি। তারা ঠিকঠাকমতো দায়িত্ব নিয়ে মনিটরিং (তদারকি) করলে এ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি এড়ানো যেত।

তদন্তে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা, ভবন নির্মাণে নীতিমালা না মানা, ফায়ার সার্ভিসের এনওসি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নেওয়া, শিশুশ্রমসহ কারখানা মালিকের নানা ধরনের অনিয়মের চিত্রও উঠে এসেছে।

বৃহস্পতিবার রাতে তদন্ত কমিটি আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শামীম ব্যাপারী জেলা প্রশাসকের কাছে ৪৪ পৃষ্ঠার এই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ্ রোববার রাতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

জেলা প্রশাসক বলেন, ওই কারখানায় অগ্নিনির্বাপণে পর্যাপ্ত সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা ছিল না, আগুন নেভানোর জন্য কারখানায় প্রশিক্ষিত জনবল (শ্রমিক) ছিল না, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের এনওসি (অনাপত্তিপত্র) পাওয়া যায়নি, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছিল না, বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণ, শিশুশ্রমসহ নানা অনিয়ম পেয়েছে তদন্ত কমিটি। জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ্ বলেন, প্রতিটি বিভাগ যদি ঠিকভাবে কারখানা মনিটরিং (তদারকি) করত, তাহলে সেখানে শিশুশ্রম থাকত না, বিল্ডিং কোডের অসংগতি থাকত না। ফায়ার সেফটি ব্যবস্থা পর্যাপ্ত থাকত। তাহলে এ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি এড়ানো যেত। তাদের তদারকির কমতি পেয়েছে তদন্ত কমিটি। জেলা প্রশাসক জানান, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন শ্রম মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি বলেন, কারখানার নিচতলার কেন্দ্রীয় গুদামের কমপ্রেসারের রুমের এক পাশে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। রাসায়নিকের উপস্থিতি থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার পর ধোঁয়া বের হলে শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়।

তখন চতুর্থ তলার ফ্লোর ইনচার্জ শ্রমিকদের আশ্বস্ত করেন, আগুন নিভে যাবে। এরপর শ্রমিকদের তার রুমে নিয়ে যান। পরে আগুন ছড়িয়ে পড়লে শ্রমিকেরাসহ তিনি ওই রুম থেকে আর বের হতে পারেননি, সেখানেই একটি কক্ষে আগুনে পুড়ে তাদের মৃত্যু হয়। তদন্ত কমিটি কারখানার প্রতি তলায় নেট দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরির প্রমাণ পেয়েছে।

জেলা প্রশাসক বলেন, তদন্ত কমিটি আগুনে বেঁচে যাওয়া ওই কারখানার শ্রমিক, সংশ্লিষ্ট মোট ২১ জনের জবানবন্দি নিয়েছে। তদন্ত কমিটি সরকারি নয়টি সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে তদন্ত কাজ করেছে।

তদন্ত কমিটি কারখানায় শিশুশ্রম বন্ধে নিয়মিত তদারকি করা, যেসব শ্রমিক মারা গেছেন তাদের শ্রম আইন অনুসারে কারখানার মালিকপক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান, বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের আড়াই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান, নিহত শ্রমিকদের পরিবারের কর্মক্ষম কেউ থেকে থাকলে তাকে ওই মালিকের অন্য কারখানায় চাকরির ব্যবস্থাসহ ২০ দফা সুপারিশ পেশ করেছে।

উল্লেখ্য, গত ৮ জুলাই রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস কারখানায় আগুনে পুড়ে ৫২ জনের মৃত্যু হয়। ইতিমধ্যে ৪৫ জনের লাশ পরিচয় শনাক্ত করার পর নিহতের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এ ঘটনায় গত ১০ জুলাই কারখানা মালিক আবুল হাসেম, তাঁর চার ছেলেসহ আটজনের বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেন। ওই দিনই আবুল হাসেম, তাঁর চার ছেলেসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সম্প্রতি হাসেম ও তাঁর চার ছেলে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। গত ১৫ জুলাই মামলার তদন্তভার সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়।