পূর্বাচলের রেস্টুরেন্টগুলো যেন মিনি পতিতালয়
কয়েক বছর আছেও ছিল ঝোপ ঝাড় জঙ্গলে ঘেরা। এ জঙ্গলে শাক সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ হত। পূর্বাচলের ফল ও শাক সবজির অনেক কদর ছিল সারা দেশেই। আধুনিক ঢাকা গড়ার নামে এসব ঝোপঝাড় অধিগ্রহন করে শুরু হয় নতুন ঢাকা প্রকল্পের কাজ। কেটে উজার করা হয় বনভূমি। বালি মাটি ফেলে ভরাট করা হয় ফসলি জমি। তৈরি হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার স্থায়ী কেন্দ্র। হচ্ছে শেখ হাসিনা ষ্টেডিয়াম। আধুনিক সুযোগ সুবিদাসহ বড় বড় অট্টালিকাও তৈরি হবে এ শহরে। এ সুযোগে অনেকে প্লট কিনে সুরম্য বাড়ি তৈরি করে হোটেল রেস্টুরেন্ট তৈরি করছেন।
আর এসব হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোতে গোপনে চলছে নারী ব্যবসা আর মাদকের রমরমা আসর। অল্প সময়েই এসব হোটেল রেস্টুরেন্টের মালিকরা হয়ে যাচ্ছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। রাত যতই গবীর হয় এসব রেস্টুরেন্টে পতিতাদের আনাগোনা বেড়ে যায়। বেড়ে যায় মাদকসেবী ও কারবারীদের চলাচল।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পূর্বাচল উপ-শহরে বিনোদনের নামে চলছে মাদক ব্যবসা ও অসামাজিক কর্মকান্ড। এতে করে এ শহরে প্রায় সময়ই অজ্ঞাত যুবক-যুবতীর লাশ পাওয়া যাচ্ছে। এসব কারনে স্থানীয়রা থাকেন চরম আতঙ্কে। হোয়াইট হাউজ রেস্টুরেন্ট এন্ড মিউজিক্যাল ক্যাফে রেস্টুরেন্টে পুলিশের অভিযানের পর বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। প্রভাবশালীদের যাতায়াতে রেস্টুরেন্টটি একটি মিনি পতিতালয়ে পরিনত হয়েছিল।
গত বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার দিকে রেস্টুরেন্টটি পুলিশ অসামাজিক কার্যকলাপের কারণে সিলগালা করে দিলেও গত শনিবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে রেস্টুরেন্টটির খোলা অবস্থায় দেখা গেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রূপগঞ্জ উপজেলার ইছাপুরা এলাকার মোবারক-মুক্তা দম্পতি পূর্বাচল উপ-শহরের ১ নং সেক্টরে হোয়াইট হাউজ গড়ে তোলেন। রেস্টুরেন্টটিতে রাত থেকে শুরু করে ভোর ৬ টা পর্যন্ত চলে ডিজে পার্টি, মাদক সেবকসহ নানা অপকর্ম। রেস্টুরেন্টটির পাশে মোবারক-মুক্তা দম্পতি একটি প্লট ভাড়া নিয়ে ১৫ টি রুম করে গড়ে তোলেন এক মিনি পতিতালয়। মিনি পতিতালয়ে প্রতিরাতের জন্য দিতে হয় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। এখানে প্রভাবশালীদের অবাধ যাতায়াত ছিল। মোবারক-মুক্তা দম্পতি গত দুই বছর ধরে এই মিনি পতিতালয় এখানে চালালেও প্রভাবশালীদের প্রভাবে প্রশাসন ছিল নীরব।
মোবারক-মুক্তা দম্পতি রেস্টুরেন্টটির মূল মালিক হলেও রেস্টুরেন্টটি পরিচালনা করতো মোবারকের শশুর নজরুল ইসলাম। রাত ৮ টার পর থেকে বিলাসবহূল গাড়ি দিয়ে প্রভাবশালীরা এখানে এসে রাতভর পার্টি করতো। এখানে আসা সবার মন যোগাতে রাখা হতো সুন্দরী নারী। ডিজে পার্টি শেষে চাইলেই যেকোন নারী নিয়ে মোবারক-মুক্তার মিনি পতিতালয়ে রাত কাটাতো তারা।
কথা হয় মিনি পতিতালয়টির আশেপাশে বসবাসকারী কয়েকজনের সঙ্গে তারা জানান, মোবারক-মুক্তা দম্পতির কয়েক বছর আগেও নূন আনতে পানতা ফুরাতো। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় দেহ ব্যবসা ও মাদক ব্যবসা করে কয়েক বছরের বনে গেছেন কোটিপতি। তাদের নামে বেনামে রয়েছে অঢেল সম্পত্তি। এই রেস্টুরেন্টটি দেওয়ার পর থেকে আশপাশে বসবাসকারী বাসিন্দারা অতিষ্ট হয়ে পড়েছে। স্থানীয়দের সামনে এসকল অপকর্ম চললেও কেউ প্রতিবাদ করার সাহসটুকু পায় না। এছাড়া বিনোদনের নামে এসব মাদক ব্যবসা ও অসামাজিক কর্মকান্ডের কারনে প্রায় সময়ই অজ্ঞাত যুবক-যবতীদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে পুর্বাচল উপশহরে। ইতি মধ্যে বেশ কয়েকটি লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
সূত্র জানায়, পূর্বাচলের এসব রেস্টুরেন্টের অবস্থান পূর্বাচলের ফারুক মার্কেট, লেংটার মাজার এলাকা, ২১নং সেক্টরের ভাসমান ও অস্থায়ী রেস্টুরেন্ট, হেলিপ্যাড চত্তর, জয়বাংলা চত্তর, জঙ্গলবাড়ি রিসোর্ট। আবার শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসমান রেস্তোরা,ভাসমান লঞ্চ বিনোদন ও স্পীডবোটের আড়ালে দর্শনার্থীদের অবাধ মেলামেশার সুযোগ করে দেয়া হয়। এছাড়াও দর্শনার্থীদের বিনোদন দিতে দিনে কিংবা রাতে অবকাশ যাপনসহ মাদক সরবরাহ, জুয়ার আসরের ব্যবস্থা রাখা হয়। একইভাবে বালু নদীদে উন্মুক্ত পিকনিকের নামে অশ্লীল গান বাজিয়ে ডিজে পার্টিসহ মাদক সেবন করে প্রকাশ্যেই। বাদ যায়নি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়াও।
পূর্বাচলের ১নং সেক্টর এলাকার একটি শশ্মান ঘাটে অবাধে মাদক সেবন আর জুয়ার আড্ডা বসায় স্থানীয় চিহ্নিত জুয়ারীরা। অভিযোগ রয়েছে, ওই শশ্মানে মাদক রেখে পূর্বাচলের বিভিন্ন স্পটে মাদক সরবরাহ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, এসব রেস্টুরেন্টে অবাধে মাদক সেবনের সুযোগ দেয়া, আর বাঁশের বেড়ার প্রাচীর করে যৌনক্রিয়ার সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে স্থানীয় অস্থায়ী হোটেল মালিকরা হাতিয়ে নেন বড় অংকের অর্থ। এছাড়াও সুযোগ পেলেই নারী কপোত কপোতিকে নাজেহাল করে সর্বস্ব লুটে নেয়ারও রয়েছে অভিযোগ।
সূত্র আরো জানায়, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকতল্পের অধীনে ৩০টি সেক্টরের অবস্থান নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার সদর এবং দাউদপুর ইউনিয়নসহ গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানার বরকাউ ও পারাবর্তা মৌজায়। এখন পর্যন্ত প্লট মালিকদের বসবাস শুরু না হওয়ায় এখনো স্থানীয় কতিপয়দের অস্থায়ী ফসলাদি ফলন আর অস্থায়ী ঘরবাড়িতে বসবাস দেখা যায়। আবার প্লট মালিকদের কেউ কেউ সীমানা প্রাচীর করে স্থানীয়দের দেখাশুনা দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। সেই সুযোগে ওই প্লটে গড়ে তুলেছে অস্থায়ী সুইমিং পুল নামের অবাধে অশ্লীল বিনোদনের ব্যবস্থা। পূর্বাচলের ১নং সেক্টর এলাকায় এমন সুইমিং পুলের সংখ্যা ৩টি। এদের কেহই কোন নাম ব্যবহার না করেই চালাচ্ছে এসব। আবার পূর্বাচলের ৩নং সেক্টর এলাকায় অনেকটা আবাসিক ব্যবস্থার মতো গড়ে তোলা হয়েছে সুইমিং পুলসহ স্থায়ী রেস্টুরেন্ট।
এর আগে, গত বৃহস্পতিবার দেহ ব্যবসা, মাদক ব্যবসাসহ নানা অভিযোগে রাত আড়াইটার দিকে হোয়াইট হাউজ রেস্টুরেন্টে অভিযান পরিচলনা করে পুলিশ। এসময় নৃত্য শিল্পী পরিচয়ে ১১ জন পতিতা, ৭ জন খদ্দের, ও রেস্টুরেন্টের কর্মচারী পরিচয়ে ৬ জন মাদক ব্যবসায়ীসহ মোট ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এসময় তাদের কাছ থেকে ৯ ক্যান বিদেশী বিয়ার ও ৩ বোতল বিদেশী মদ, নগদ ২লাখ ৪৭ হাজার ৫’শ টাকাসহ বিপুল পরিমান জুয়া খেলার সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। প্রভাবশালীদের ছত্রছাঁয়ায় মোবারক-মুক্তা দম্পতি ও নজরুল ইসলাম রয়ে গেছে অধরাই। পুলিশ রেস্টুরেন্টটি ও তার সাথে মিনি পতিতালয়টি সিলগালা করে দেয়। সিলগালার একদিন না পেরোতেই শনিবার দুপুরে গিয়ে রেস্টুরেন্টটির তালা ভাঙ্গা অবস্থা দেখা যায়। সিলগালা রেস্টুরেন্টটি পূনরায় রেস্টুরেন্টটি চালু করেছে হয়ে বলে জানা যায়।
রূপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এ এফ এম সায়েদ বলেন, পূর্বাচলে একটি রেস্টুরেন্ট ব্যবসার আড়ালে মাদক ও ডিজে পার্টি জুয়ার আড্ডা ও আসামাজিক কার্যকলাপ চলছে বলে পুলিশের কাছে সংবাদ ছিল।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে হোয়াইট হাউজ রেস্টুরেন্টে অভিযান পরিচালনা করা হয়। জেলা ’গ’ সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আবির হোসেন বলেন, পূর্বাচলে হোয়াইট হাউজ নামে একটি রেস্টুরেন্টে অভিযান পরিচালনা করে ২৪ জন গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তাদের কাছ নগদ টাকা ও বিপুল পরিমান মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। আমাদের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। রেস্টুরেন্টের ব্যবসার আড়ালে যেখানেই অসামাজিক কার্যকলাপ চলবে সেখানেই পুলিশ অভিযান চালাবে।