যশোরঃ জেলার বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচারের জন্য স্বর্ণ চোরাচালানীদের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে সাদীপুর সীমান্ত। এই পথ দিয়ে দিনে ও রাতে বাংলাদেশ থেকে পার হচ্ছে কোটি কোটি টাকার স্বর্ণ এবং ভারত থেকে আসছে অস্ত্র, ফেন্সিডিল, গাঁজা, ওষুধ, মাছের পোনা, মোবাইল ফোন, কসমেটিক্স, কেমিকেল। আর এই ঘাট চালানোর নেপথ্যে রয়েছেন সীমান্তের প্রভাবশালী একটি মহল। প্রশাসনের আড়ালে অবৈধ পন্থায় ঘাট তারা চালিয়ে কামিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।
বেনাপোল চেকপোষ্ট ইমিগ্রেশন হাউজের পেছন থেকে শুরু করে রঘুনাথপুর সীমান্ত পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সীমান্ত জুড়ে দিনে ও রাতে চলে স্বর্ণ পাচারের মহাউৎসব।
জানা যায়, বেনাপোল চেকপোষ্ট হতে রঘুনাথপুর সীমান্ত পর্যন্ত চোরাচালানের রুট হিসাবে ৬টি ঘাট ব্যবহার করা হয়। ঘাট গুলো জয়ন্তীপুর পোতার পোষ্ট, ডাক্তার বাড়ী, লেবুতলা পোষ্ট, নাপিত বাড়ী জল ঘাট, ইদুর বাড়ি পোষ্ট, আমবাগান মাঠ পোষ্ট এর মধ্যে অন্যতম। সাদীপুর সীমান্তের ওপারে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া অরক্ষিতসহ সাদীপুর জয়ন্তীপুর পোতার পোষ্ট স্থল পথ এতটায় নিকটে যে, দুই থেকে তিন মিনিটে সাদীপুর হতে ভারতের জয়ন্তীপুর চলে যাওয়া যায়। যার ফলে সীমান্তের দুই পাশে সক্রিয় চোরাচালান চক্রের হোতারা সহজে স্বর্ণ পাচার করতে সক্ষম হচ্ছে। সাদীপুর দুই দেশের সীমান্ত ঘেঁষে এমনভাবে মানুষের বসবাস যে শনাক্ত করাই কঠিন কোনটা বাংলাদেশ আর কোনটা ভারত। ওপারে মিজান মোল্লা ও ইসরাইল সর্দারের বাড়ি, সীমান্তের পাশে স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালানের একটি সক্রিয় চক্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্রিকেট বলের মতো টান মেরেও পার করছে স্বর্ণ।
স্থানীয় বাসিন্দাদের তথ্য মতে জানা যায়, সাদীপুর সীমান্ত নিয়ন্ত্রন করে একটি সক্রিয় মহল। সেখানে গ্রামের ৩০ থেকে ৪০টি যুবক দিয়ে বিভিন্ন পন্থায় এই রুট ব্যবহার করা হচ্ছে। বিগত সময়ে সীমান্তের এই সাদীপুর গ্রামকে ‘সোনাপুর’ বলে আখ্যায়িত করা হতো। বর্তমানে সেটা আবারও পূর্ণ রুপ ধারন করেছে। এদিকে স্বর্ণ পাচারের জন্য বিভিন্ন পেশার মানুষেরা এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন। বাড়তি আয়ের জন্য সীমান্তের গ্রামের যুবক, বৃদ্ধ ও নারীরা এ পেশায় নেমেছেন। গত ১৭ মে সাদীপুর সীমান্ত দিয়ে পাচারের জন্য স্বর্ণ বহন অবস্থায় বিজিবির হাতে ১০টি বারসহ আটক হয় সুমন মিয়া।
তার ভাষ্য মতে যশোর থেকে সীমান্ত পর্যন্ত এক একটি স্বর্ণের বারের জন্য মিলতো ৫৫০ টাকা। গত ৯ মার্চ ৪টি স্বর্ণের বারসহ সীমান্তের আব্দুল জলিল, ১৪ মার্চ ১০টি স্বর্ণেরবারসহ আব্দুল ওহাব, ১৫টি স্বর্ণের বারসহ রানা হামিদ, ৫৭টি স্বর্ণেরবারসহ বানেছা খাতুন, ৪৯ টি স্বর্ণের বারসহ আব্দুল মমিন, ৪৯টি স্বর্ণের বারসহ শামিম হোসেন সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যদের হাতে আটক হয়।
এদিকে একের পর এক আটক হলেও প্রকৃত মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে, পাচারকারীদের যে সব সদস্য ধরা পড়ছেন তারা বলছেন আমরা বাহকমাত্র। কিছু টাকার বিনিময়ে এসব স্বর্ণ একটি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেয়াই আমাদের কাজ। কিন্তু তাদের কাছে স্বর্ণের বারগুলো কারা দিয়েছেন, তা জানাতে নারাজ পাচারকারীরা। পুলিশের রিমান্ডে তারা নাম বলেন ভারতীয় কোনো নাগরিকের। পরে প্রকৃত সোনার মালিকেরা এসব আসামিদের আদালত থেকে জামিন করিয়ে নেন। আটক আসামিরা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন।
সাদীপুরের বাসিন্দা দুলাল আহম্মেদ জানান, সাদীপুর সীমান্ত দিয়ে দেদারছে স্বর্ণ পার হবার কারনে এখন আর মাঠে কাজ করার মতো শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। বেশি আয় এবং কষ্ট লাঘব হওয়ায় তরুনরা ঝুঁকে পড়ছে স্বর্ণ বহনের কাজে। এছাড়াও সাদীপুর সীমান্ত দিয়ে মাদকসহ অবৈধভাবে চড়া মূল্যে লোক পারাপার হচ্ছে। গত ১৯ মে ভারতীয় নাগরিক বাদশা ভাস্কর সাদীপুর দিয়ে পার হয়ে পোড়াবাড়ী নারানপুর গ্রামে উঠেছেন বর্তমান তাকে বেনাপোলের একটি আবাসিক হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এছাড়াও সাদীপুর সীমান্ত ঘাট দখল কেন্দ্র করে গ্রামে একাধিক সংঘর্ষ ঘটেছে।
সীমান্তের সচেতন মহলের দাবি, শুধু বিজিবি, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর প্রচেষ্টায় মাদক পাচার রোধ করা কঠিন। যেহেতু ভারত থেকে মাদক আসছে, তাই সেদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের আন্তরিক সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। আর বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, তারা সব ধরনের পাচার রোধে আন্তরিক হয়ে কাজ করছেন। তবে অভিযোগ রয়েছে, মাদক পাচার রোধে বিজিবি কঠোর থাকলেও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ অতটা সতর্ক নয়। এতে অনায়াসে মাদক দ্রব্যসহ বিভিন্ন চোরাচালান পণ্য অনায়াসে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে।
বেনাপোল পোর্ট থানার অফিসার ইনচার্জ মামুন খান বলেন, বেনাপোলের বিভিন্ন সীমান্তে পাচারকারীদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্বর্ণ পাচার বর্তমানে বেড়ে গেছে। গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় পাচারকারীরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসে। আমরা মাদকবিরোধী অভিযান ও মাদক উদ্ধার কার্যক্রম অভিযান অব্যাহত রেখেছি। মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গডফাদার যেই জড়িত থাক, তাদের সঙ্গে কোনও আপস নয়। মাদক ব্যবসায়ীদের পক্ষে যে সুপারিশ করবে তাকেও ছাড় দেওয়া হবে না।
যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো: সেলিম রেজা বলেন, দেশের অভ্যন্তরে মাদকসহ যাতে কোন ধরনের অবৈধ পণ্য দেশে প্রবেশ করতে না পারে ও স্বর্ণসহ অন্যান্য পণ্য ভারতে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা সর্বদা সতর্ক রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি কোভিড-১৯ এর মধ্যেও ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়ন গত ২০২০ সালে ১৩ জন আসামীসহ ৪১.৭২২ কেজি স্বর্ণ, ও ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত ৫ জন আসামীসহ ৭.৩০৩ কেজি স্বর্ণসহ সর্বমোট ৪৯.০২৫ কেজি স্বর্ণ এবং আসামী ১৮ জন স্বর্ণপাচারকারীকে আটক করতে সক্ষম হয়। যার মূল্য বাংলাদেশী টাকায় ৩২ কোটি ৯০ লাখ ৬২ হাজার ৩৪০ টাকা।