শিপ্রা গোস্বামী একজন মানবাধিকার কর্মী ও ছাদ বাগান প্রেমিক
সুমন ইসলাম, ফরিদপুর জেলা প্রতিনিধি
জুন ৫, ২০২১, ০৫:৫৬ পিএম
ছবিঃ আগামী নিউজ
ফরিদপুরঃ এ্যাডভোকেট শিপ্রা গোস্বামী গাছ ভালবাসেন খুব ছোটবেলা থেকেই। ঠিক কবে থেকে তা তিনি বলতে পারেন না। তার মনে পড়ে, একবার তাকে এক সহপাঠী ছোট্ট ডালসহ একটা গন্ধরাজ ফুল উপহার দিয়েছিল। বাসায় নিয়ে এসে একটা কাঁচের পুরানো ওষুধের বোতল ধুয়ে সেটিতে রেখেছিলেন। এক সময় ফুলটি শুকিয়ে গেলেও পাতাসহ ডালটি বেশ তরতাজা হয়েছিল। একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখেন, গন্ধরাজের ডালে ছোট্ট দুটো নতুন পাতা উঁকি দিচ্ছে। এ যেন এক আবিষ্কার! আনন্দে নাচতে নাচতে পরিবারের সকলকে দেখিয়েছিলেন গাছটি। ক'দিন পর আরো কিছু পাতা গজালে একটা দইয়ের খুটিতে মাটি দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে গাছের প্রতি প্রেম শুরু।
ফরিদপুর শহরে ছোট্ট একটা বাড়ি করেছেন শিপ্রা দিদি। বাড়ির ছাদে সাধ মিটিয়ে নতুন নতুন গাছ লাগিয়েছেন তিনি। তার ফুল গাছের প্রতিই আকর্ষণ বেশি, বিশেষ করে শীতকালীন ফুল ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকাসহ প্রায় ২৫/৩০ জাতের ফুল। একবার ক্যামেরা শিল্পী নাসির আলী মামুন ভাই তার বাগান দেখে বলেছিলেন, কারো ছাদে ব্যাক্তিগত সংগ্রহে এতো মৌসুমী ফুল আমি কখনো দেখিনি। সেদিন খুব উৎসাহ পেয়েছিলেম শিপ্রা গোস্বামী। আইনের পেশার পাশাপাশি জেনে নিয়েছিলেন ছাদ বাগানের আইন কানুন।
বাগানে ২০০ টিরও বেশি গাছ আছে। ফুলের মধ্যে জবা, বেলি, গোলাপ, এডেনিয়াম, কলাবতী, জুঁই, শিউলী, নাগচম্পা, অলকানন্দা, কামিনী, স্থলপদ্ম, পায়েনসেটিয়া, নয়নতারা, পর্তুলিকা, দোলনচাঁপা, টগর, অরেঞ্জ মার্মালেড, মেক্সিকান বাটারফ্লাই, অপরাজিতা, রঙ্গন, রাধাচূড়া, গন্ধরাজ, হাস্নাহেনা, কাঠ গোলাপ, বাগান বিলাস, রুসেলিয়া ইত্যাদি। ফলের মধ্যে, আম, লেবু, মাল্টা, বরই, কদবেল, কামরাঙা, পেয়ারা, সফেদা। এছাড়াও অল্প কিছু শাক সব্জিও আছে যেমন, বেগুন, মরিচ, বরবটি, শসা, লাল শাক, পুঁইশাক এবং কলমী শাক। এবার শীতে প্রচুর টমেটো, বাঁধাকপি, সীম আর বেগুন হয়েছে।
ছাদ বাগান নিয়ে একটা ঘটনার কথা বলেছিলেন শিপ্রা গোস্বামী “একবার চিকিৎসক কর্তা ভাংগা উপজেলা থেকে ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে বদলী হলেন। মালপত্র আনার জন্য ভাড়া করা হল ট্রাক। সেই ট্রাকে ভাংগা থেকে ফরিদপুর তিনটি ট্রিপ দিতে হয়েছিল। একটি আসবাবপত্রের জন্যে আর দুটি গাছের জন্যে। এই নিয়ে কিছুদিন আগেও কথা শুনিয়েছেন চিকিৎসক স্বামী”।
শিপ্রা দিদি আরো বলেন, “বাইরের লোক দিয়ে যখনই বাড়িতে কোনো কাজ করাই, তার প্রথম শর্ত থাকতো গাছের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। একবার এক রং মিস্ত্রি না বুঝে আমার গোলাপী জবা গাছ গোড়া থেকে কেটে দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল যেন আমার বুকের পাঁজড়ে সজোরে কেউ আঘাত করেছে। প্রচন্ড রাগারাগি করেই ক্ষান্ত হইনি, সেদিনের পাওনা মিটিয়ে আর এক মুহূর্তও কাজ করতে না দিয়ে বিদেয় করে দিয়েছিলাম। এখনো সেই গাছটির জন্যে আফসোস হয় আমার”।
একবার চিকিৎসক স্বামীর উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। ছাদ বাগানের দায়িত্বটা একজনকে দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি তেমন গুরুত্ব দেননি। দেশে ফিরে দেখেন ৮০ভাগ গাছই মরে গেছে। খুব কেঁদেছিলেন সেসময়, খাওয়া-দাওয়াও ঠিক মত করেননি। অভিমান করে প্রায় ১ দশক গাছ থেকে দূরেই ছিলেন। ছাদেই যেতেন না, গাছও লাগাতেন না। অনেক টব ছিলো, তার থেকে কিছু অন্যদের দিয়ে দিয়েছিলেন, বাকীগুলো মাটি ফেলে দিয়ে উপুড় করে রেখেছেন। তিনি জানতেন ছাদ বাগান বা গাছ ছাড়া তিনি থাকতে পারবেন না।
দিদি আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন, হঠাৎই ২০১৭ তে মধু কবির বাড়িসহ দর্শনীয় কিছু জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। আর গেলাম ফুলের রাজ্য যশোরের গদখালীতে। আমার সাথে অনেকেই নানা রকম ফুলের চারা কিনলো। সুন্দর সেই গাছগুলি দেখে আমিও সব অভিমান জলাঞ্জলি দিয়ে কয়েকটা গোলাপ আর একটা শ্বেত জবা কিনে আনলাম। আবার শুরু হল আমার ছাদ বাগান। ক্রমেই কলেবর বাড়তে লাগল। বাড়িতে থাকলে সকাল এবং সন্ধ্যেটা ওদের জন্যেই বরাদ্দ থাকে।
করোনাকালে হতাশাগ্রস্থ না হয়ে বাগানের প্রতি আরো মনযোগী হয়েছি। গাছের সংখ্যাও বেড়েছে। শুধু ফুল নয়, করছি ফল এবং সব্জিও। আমি ঘুম থেকে উঠে বাগানে যাই, বাগান দেখে ঘুমাতে যাই আর স্বপ্নেও ওদের দেখি। কোন গাছের একটি ডাল ভেংগে গেলে মনে হয় আমিই ব্যাথা পেলাম। আমি যখন বাগানে যাই তখন আমার উদ্ভিদ সন্তানেরা আনন্দে নেচে উঠে। কাছে গিয়ে ছুঁয়ে দিলে খিল খিল করে হাসে। ওরা যে আমায় প্রবল ভালবাসে তা টের পাই আমি যখন ফরিদপুরের বাইরে যাই। ফেরার পর দেখি পুরো বাগানটা শ্রীহীন হয়ে পড়ে। ওরা এমনভাবে মলিন হয়ে যায় যেন মাতৃহীন শিশু। ওদের মান ভাঙিয়ে দুদিনের যত্নেই আবার সব আগের মত হয়ে যায়।
আসলে বাগান এখন শিপ্রাদিদির সংসারেরই অংশ তার দুঃখ কষ্ট হতাশা ভুলে থাকার ম্যাজিক। একটি দিনও ওদের ছাড়া থাকার কথা ভাবতে পারেন না। যতদিন বাঁচবেন ততদিন সবুজের সমারোহেই বাঁচতে চান।