রাজশাহীঃ সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র আব্দুল্লাহ আল মোহাম্মদ শান্ত। গত বছর দাদার কাছে বাইনা ধরেছিল, তালাপাতার বাঁশি, ড্যাপধানের খই আর বন্ধুদের নিয়ে নাগর দোলায় চড়বে। কিন্তু করোনার মহামারি কারণে সে বছর মেলা হয়নি।
সেই একই কারণে এবারও মেলা হচ্ছেনা। শুধু শান্তই নয়, তার মতো অনেকেরই আশা ছিল মেলায় ঘুরবে। কেনাকাটা করবে হরেক রকমের পণ্য। বিভিন্ন পণ্য ব্যবসায়ীরাও আশায় ছিলেন দোকান বসিয়ে বেচা বিক্রি করবেন। কিন্তু করোনাকালে থমকে গেছে, রাজশাহী বাঘার ঐতিহাসিক ঈদ মেলা। এ মেলার ঐতিহ্য প্রায় ৫০০ বছরের।
শুধু বাঘা নয়, আশপাশের বিভিন্ন উপজেলার মানুষের ঈদ আনন্দের সঙ্গে বাড়তি আনন্দ যোগায় ঐতিহ্যবাহী এই ঈদমেলা। এমনকি পাশ্ববর্তী ভারতের সীমান্তের ওপারে যাদের স্বজনরা আছেন, তারা বছরের এই সময়টা বেছে নেন একে অপরের সাথে দেখা করার। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাদের বাস তারাও ছুটে আসেন। রমজান শেষে পুনরায় ফিরছে ঈদ। কিন্তু খুশির ডালা সাজিয়ে নয়। করোনানার মহামারির আকালের দিনে এবারও এসেছে এক 'বিষ' ঈদ।
প্রায় ৫শ বছরের ইতিহাসে হয়রত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহদৌলা(রহঃ) ও তদ্বীয় পুত্র হযরত শাহ আব্দুল হামিদ দানিশ মন্দ (রহঃ) এর পবিত্র ওরশ উপলক্ষে ঈদুল ফিতরের ঈদে অনুষ্টিত হয় মেলা। যা ঈদ মেলা নামে খ্যাত। এবারেও মেলা, ওরশ কোনটাই হচ্ছেনা। করোনায় পর পর দুইবার বাঘার ঐতিহাসিক ঈদগাহে নেই বড় জামাতের আয়োজন। দুর-দুরান্তের লোকজন আসতেন বড় জামায়াতে নামাজ আদায়ের জন্য। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে মসজিদে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে জামাত করতে হবে। তাই নামাজ শেষে দূর থেকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে।
লাখো মানুষের প্রাণের ছোঁয়ায় ঈদ মেলা থেকে তাল পাতার বাঁশি আর মিঠাইসহ হরেক রকমের পণ্য কেনার সেই দৃশ্য এবারও চোখে পড়বেনা। সন্ধ্যার আবছায়ায় আকাশে বাঁকা চাঁদের হাসি দেখা যাবে ঠিকই। কিন্তু আবাল বৃদ্ধ বনিতা ও শিশুদের মিলিত আনন্দ কলরব শোনা যাবেনা মেলায়।
মেলা প্রাঙ্গনের বাসিন্দা, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান খন্দকার মনোয়ারুল ইসলাম মামুন বলেন, বিশেষত ১৫ রোজার পর পরই শুরু হতো মেলার আয়োজন। প্রায় ৩ হাজার পণ্য ব্যবসায়ী পসরা সাজিয়ে বসতেন মেলায়। পণ্য বেচা-কেনা চলতো গভীর রাত পর্যন্ত। বিভিন্ন নামের মিষ্টি, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, বাচ্চাদের খেলনা, কসমেটিক্স, লৌহজাত ও বাঁশ-বেতের তৈরি সামগ্রী ছিল মেলার প্রাচীন ঐতিহ্য। হালে যোগ হয়েছে. নাটোরের বনলতা ও সদরঘাটের ঐতিহ্যবাহী পান। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ভরে উঠতো মেলা প্রাঙ্গন। ওরশের আগে খানকাবাড়ি রাতভর চলতো সামা, কাওয়ালি, মারিফতি গান। বিনোদন প্রেমীরা আনন্দে মেতে উঠতো খেলা ধুলা,গান বাজনায়। তাদের সবার মুখে বিষন্নতা। তাদের প্রশ্ন, সবকিছু চললে মেলা কেন হলোনা।
কসমেটিক্স ও খেলনা সামগ্রী পাইকারি বিক্রেতা শহিদুল ইসলাম বলেন, মেলা উপলক্ষে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকার মালামাল বিক্রি করতেন। দুই বছর থেকে সেটি হচ্ছেনা। ভ্রাম্যমান খেলনা সামগ্রী বিক্রেতা জহির বলেন, মেলায় দুই সপ্তাহ বেচা কেনা করে যে লাভ হতো, তা দিয়ে ৩ সদস্যও, ১/২ মাসের খরচ চলতো।
এদিকে ঈদ সামনে রেখে শপিংমল, বিপণী বিতানে শুরু হয়েছে কেনাকাটা। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রামক রোধে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের চিত্র ছিল একেবারেই নাজুক। বেশিরভাগ দোকানেই শর্ত অনুসরণ করে চলেনি। দোকানে জীবাণুনাশক দিয়ে স্প্রে বা হ্যান্ড স্যানিটাইজারও ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। অনেক ক্রেতা-বিক্রেতাকে মাস্ক পরতে দেখা যায়নি। মাস্ক থাকলেও সেগুলো থুতনিতে রেখে কেনাকাটা করতে দেখা গেছে।
ক্রেতারা বলেন, মাস্ক মুখে থাকলে প্রচন্ড গরমে মাস্ক ভিজে যায়। মনে হয় দমবন্ধ হয়ে যাবে। অন্যদিকে বড় শপিংমলে কমবেশি ভিড় থাকলেও নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের কেনাকাটার জায়গা হিসেবে পরিচিত অধিকাংশ মার্কেট বেচাকেনায় জমে উঠেনি।
রোববার (৯ মে) উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। রাত ৮টার পর কেনাকাটায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বেশিরভাগ দোকানে তা অনুসরণ করেনি। পুরণো চেহারায় রাত পর্যন্ত দোকান খুলে কেনা কাটা করতে দেখা গেছে। খাবার রেস্টুরেন্টগুলোতে বসে খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা থাকলেও বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টেই তা মানা হয়নি।সে ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারি সংস্থার তৎপরতা চোখে পড়েনি।
ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন, সবকিছু চললে শপিংমল, বিপণি বিতান কেন চলতে পারবে না। বাঘা পৌরসভার জিরো পয়েন্ট এলাকার মালিক সমিতির সভাপতি শাহিন বলেন, আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকান চালানোর চেষ্টা করছি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার পাপিয়া সুলতানা বলেন, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে চলাচল নিশ্চিত করতে, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে কয়েক জনকে জরিমানাও করা হয়েছে। বড় কথা হলো, সংক্রামক থেকে বাঁচতে হলে নিজেদের সচেতন হতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে মসজিদে জামাত আয়োজনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। লোকসমাগম এড়াতে মেলার অনুমতি মেলেনি।