যশোর হাসপাতালে চিকিৎসা বঞ্চিত করোনা রোগীরা

বিল্লাল হোসেন,যশোর প্রতিনিধি এপ্রিল ৩০, ২০২১, ০৯:৫৫ পিএম
সংগৃহীত

যশোর: জেলায় ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের রেডজোনে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন করোনায় আক্রান্ত রোগীরা। এখানে চিকিৎসকদের দায়িত্ব খাতা কলমে থাকলেও বাস্তবে তাদের দেখা মেলেনা। মাঝে মধ্যে ইন্টার্নরা আসলেও দুর থেকে কথা বলে চলে যায়। আর সেবিকারা রোগীর কাছে ওষুধ ছুড়ে দেন। নাভির ইনজেকশন দেয়া হয় পেটের পশম ধরে। আবার রোগীকে হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এমনটাই জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনেরা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঠিকভাবে তদারকি ব্যবস্থা ও জবাবদিহিতা না থাকার কারণে রেডজোনে চিকিৎসাসেবায় এই ধরণের অনিয়ম চলছেই। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যশোর মেডিকেল কলেজ ও ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে মেডিসিন ও কার্ডিওলজি বিভাগে অনেক জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক রয়েছেন। এর মধ্যে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় অধ্যাপক ডা. এবিএম সাইফুল আলম, সহকারী অধ্যাপক ডা. গৌতম কুমার ঘোষ, ডা. গৌতম কুমার আচার্য্য, ডা. দেবাশীষ দত্ত, ডা. ময়নুল হক, জুনিয়র কনসালসাটেন্ট ডা. মধুসূদন পাল, কার্ডিৗলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাজল কান্তি দাঁ, ডা. খোন্দকার রফিকুজ্জামান, ডা. গোলাম মাহফুজ রব্বানী , ডা.শওকত আলী, জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. তৌহিদুল ইসলাম, ডা. ফজলুল হক খালিদ উল্লেখযোগ্য। 

রেডজোনে দায়িত্ব পালনের জন্য কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ডিউটি রোস্ট্রার রয়েছে। কিন্তু এসব চিকিৎসকের দেখা পাওয়া যেনো রোগীদের ভাগ্য। তবে ইন্টার্নরা মাঝে মাঝে রেডজোনে (করোনা ওয়ার্ড) রাউন্ডে গিয়ে দুরে দাঁড়িয়ে রোগীর সাথে কথা বলে চলে আসে। এছাড়া রেডজোনে ২৪ ঘন্টার জন্য একজন মেডিকেল অফিসারের দায়িত্ব থাকলেও তিনি থাকেন অনুপস্থিত। রেডজোনের চিকিৎসাসেবা নিয়ে রোগী ও স্বজনদের ক্ষোভের শেষ নেই। 

যশোর শহরের সার্কিট হাউজপাড়ায় বসবাসকারী সাংবাদিক জামাল হোসেন জানান, তাদের স্বামী স্ত্রীর করোনার পজেটিভ শনাক্ত হয়। গত ৭ এপ্রিল তিনি (জামাল হোসেন) যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের রেডজোনে ভর্তি হন। ভর্তির পর কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা ও ওষুধ কেনা বাবদ ব্যয় হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। এটা কিন্তু একদিনের চিকিৎসা খরচ ছিলো। তিনদিন এই হাসপাতালে থাকলেও কোন সিনিয়র চিকিৎসকের দেখা তিনি পাননি। সেবিকারা দুর থেকে ওষুধ ছুড়ে দিয়েছেন। এখানে রোগীরা আসার পর বড় অসহায় হয়ে পড়ে। রোগীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে উন্নত চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে অন্যত্র চলে যেতে পরামর্শ দেন। এক প্রকার রোগীদের হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তিনি নিজেও এখান থেকে অন্য হাসপাতালে চলে যান। 

আরেক সাংবাদিক এম আইউব রেডজোনের চিকিৎসাসেবা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কাছে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। চিঠির এক অংশে তিনি উল্লেখ করেছেন, ১০ এপ্রিল করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসার পর ভর্তি হন রেডজোনে। এরপর শুরু হয় নামকাওয়াস্তে চিকিৎসা। আউটডোরের চিকিৎসকের ওষুধই ছিল ভরসা। অক্সিজেন সিলিন্ডার যেটি ছিল তা উল্লেখ করার মতো না। বেডে ওঠার পর দু'দিনে কোনো চিকিৎসকের দেখা তিনি পাননি। সেবিকারাও দুরত্ব বজায় থেকেছেন। রোগীর কাছে আসেননি বললেই চলে।

অধিকাংশ সেবিকা এতটাই অমানবিক যে, নাভির ইনজেকশন দিয়েছিলো পেটের পশম ধরে। ১১ এপ্রিল রাতে অক্সিজেন লেবেল কমে যাওয়ায় প্রচন্ড শ্বাসকষ্টবেড়ে যায়। তখনও কোনো চিকিৎসক সেবিকা খোঁজ নিতে আসেননি। পরের দিন সকালে অক্সিজেন লেবেল ৫০ এর নীচে নেমে যায়। তখন তার স্ত্রী সেবিকাদের জানালে তারা তার কাছে অক্সিমিটার দিয়ে অক্সিজেন লেবেল দেখতে বলেন। প্রথমবার দেখার পর দ্বিতীয়বার দেখতে চাওয়ায় সেবিকাদের অমানবিক জবাব ছিলো 'বারবার দিলে ব্যাটারি শেষ হয়ে যাবে। হাসপাতালের একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তার এক নিকট আত্মীয় রেড জোনে ভর্তি ছিলো। কয়েকদিনেও কোন জ্যেষ্ট চিকিৎসকের দেখা পাননি। এক প্রকার তাদের রোগী যেনো জেলাখানায় আটকে ছিলেন। বাধ্য হয়ে সেখান থেকে রোগীকে অন্যত্র নেয়া হয়। সরকারি এই হাসপাতালে করোনার রোগীরা চিকিৎসাসেবা পান না বললেই চলে। 

গত ২ এপ্রিল হাসপাতালের রেডজোনে ভর্তি করানো হয় যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার মহিরণ গ্রামের ইদ্রিস আলীর ছেলে প্রেস মালিক সাখাওয়াত হোসেনকে (৫২)। ২৮ এপ্রিল রাতে তিনি মারা যান। সাখাওয়াতের স্বজনদের অভিযোগ, রেডজোনে রোগীকে ভর্তি করার পর যথাযথ চিকিৎসা মেলেনি। চিকিৎসা অবহেলার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। অসহায় মানুষ চিকিৎসার জন্য এখানে এসে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাখাওয়াতের স্বজনরা। 

সূত্র জানায়, করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবায় নানা অনিয়ম ও অবহেলা হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তা নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। সঠিকভাবে তদারকি ও ব্যবস্থা ও জবাবদিহিতা না থাকায় চিকিৎসক সেবিকারা ইচ্ছামতো দায়িত্ব পালন করেন। ফলে সরকারি হাসপাতালে আসা রোগীরা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। 

এই বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আরিফ আহমেদ জানান, চিকিৎসক রাউন্ডে না গেলে রোগীদের চিকিৎসা কে করেন। সব রোগীর মন সন্তোষ্ট করা সম্ভব নয়। রোস্ট্রার অনুযায়ী প্রতিদিন একজন করে কনসালটেন্ট ওয়ার্ড রাউন্ডে যান। এছাড়া সার্বক্ষনিক দায়িত্ব পালন করেন একজন মেডিকেল অফিসার। 

যশোরের সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন জানান, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসকরা যদি ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন কিনা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেখভাল করবেন। তারপরে কোন রোগী অভিযোগ পেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলা হবে। সিভিল সার্জন আরও জানান, করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে মাঝে মধ্যেই রেডজোনে খোঁজ খবর নেন তিনি।

আগামীনিউজ/নাহিদ