রাজশাহী: “লকডাউন বাড়ানো এটা গরিব মারার ফাঁদ। বড়লোকেরা বড়লোক হয়ে যাচ্ছে, কোটিপতিরা কোটিপতি হচ্ছে। কিন্ত সাধারণ লোকের মরণ। লকডাউনে সাধারণ লোক মইর্যা (মরে) শ্যাষ (শেষ) হয়ে যাইছে। চাইল (চাল) কিনার পয়সা নাই, বাজার করার পয়সা নাই। কী খাইয়্যা বাঁচব, আর কী খাইয়্যা কী করব? এভাবে কোনোদিন রাষ্ট্র চলে নাকি? এভাবে কোনোদিন রাষ্ট্র চলে না। এর চেয়ে গুলি কইর্যা মাইর্যা ফ্যালা (মেরে ফেলে) দিলে অনেক ভাল ছিল। মইর্যা (মরে) গেলে শান্তি। আল্লাহর কাছে গিয়ে, আল্লাহ যা করে কইরতো”।
মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) বিকেলে আক্ষেপের স্বরে আগামী নিউজকে কথাগুলো বলছিলেন রিকশাচালক মো. জহুরুল ইসলাম।
রাজশাহী নগরীর এক গ্যারেজের দিন চুক্তিতে নেয়া একটি রিকশায় উপার্জিত ভাড়ার টাকায় সংসার চালান তিনি। যা আয় করতেন- তার মধ্যে ৫০০ টাকা মালিককে দিতে হতো এবং বাকি টাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কেনোমতে দু’মুঠো খেয়ে দিন কেটে যেত তার। কিন্ত দ্বিতীয় দফায় আবারো লকডাউন বৃদ্ধি হওয়ায় চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি।
পড়ন্ত বিকেলে সুযোগ পেয়েই আগামী নিউজকে জানান মনের কিছু ব্যাথা ও লকডাউন নিয়ে প্রতিক্রিয়া। করোনার প্রকোপ রোধে সরকারীভাবে জারিকৃত লকডাউন দ্বিতীয় দফায় বাড়ানোর বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।
জহুরুল ইসলাম বলেন, “আমরা তো দিনমজুর। এক কেজি চাইল (চাল) পাই না। সরকারেক আমরা ভোট ঠিকই দিই। কিন্ত এক কেজি চাইল (চাল) পাই না, একটা ট্যাকা (টাকা) পাই না। এ অবস্থায় দিন কাটে? এই না খাইয়্যা (খেয়ে) রোজা থাকা যাবে? বলেন, আপনিই বলেন।” পুলিশের দিকে আঙ্গুল তুলে তিনি বলেন, “বড় বড় মাইক্রো চলছে, তাতে বাধা নেই। সামান্য ব্যাটারি চালিত রিকশা কতদূর যাবে? এই গাড়িও চলতে দিছে না। এই ইনকাম নাই। সারাদিনে মনে করেন এই মেইন রোডে তো উঠতেই দিচ্ছে না। অলি-গলিতে (সরু রাস্তা) কতক্ষণ থাইকবো?
আর অলি-গলিতে লোক কোথায় পাবো? মেইন রোডে লোক না পাইলে অলি-গলিত লোক কোথায় পাবো?”
সরকারের প্রতি দৃষ্টিপাত করে জহুরুল বলেন, “এভাবে বাইচ্যা (বেঁচে) থাকা যায় না। এর চেয়ে মরি (মারা) যাওয়া অনেক ভাল। এভাবে লকডাউন না দিয়্যা গুলি কইর্যা (করে) মাইর্যা ফ্যালা (মেরে ফেলে) দিলে শান্তি হইতো।
কারন এ অবস্থায় একটা ট্যাকা (টাকা) অনুদান নাই, এক কেজি চাইল (চাল) নাই। হ্যা, ঘরে ঘরে যদি এক বস্তা করে চাল দিয়ে সরকার যদি বলতো যে, লকডাউন করে থও (রাখ)। ব্যাস, লবন দিয়ে হলেও ভাতটা খাইয়্যা (খেয়ে)
বাঁচা যাইতো। সেটাও তো নাই। এক কেজি চাইল (চাল) কিনতে গেলে এখন ৬০-৭০ টাকা। এই গাড়ির (রিকশা) জমা (চুক্তির টাকা) দিব কীভাবে, আর আমরা চাইল (চাল) কিনব কিভাবে, আর সংসার কীভাবে চলবে? এর চেয়ে মইর্যা (মারা) যাওয়া অনেক ভাল না? মইর্যা গেলে তো কোনো চিন্তা থাকবে না।”
সবশেষে করোনায় মৃত্যুর প্রসঙ্গ টেনে রিকশাচালক জহুরুল বলেন, “এভাবে থাইক্যা কী লাভ? না খাইয়্যা (খেয়ে) কষ্ট কইর্যা (করে)। করোনাতে কী মইরবে (মরবে)? তার চেয়ে না খেয়ে মানুষ মইর্যা (মারা) যাবে। এ্যার চেয়ে মইর্যা (মারা) যাওয়া ম্যালা (অনেক) ভাল।”
লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধির ঘোষণা হওয়ায় জহুরুলের মতো আরো অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। দাবি জানিয়েছেন, লকডাউন প্রত্যাহার করে আসন্ন ঈদের প্রস্ততি নিতে সুযোগ দেয়ার।
সিটি কর্পোরেশেনের দেয়া তথ্যমতে, নগরীতে রেজিস্ট্রেশন হওয়া রিকশার সংখ্যা পাঁচ হাজার। আর ১০ হাজার অটোরিকশা রয়েছে রেজিস্ট্রেশনের আওতায়। দুই শিফটে চলে দুই রংয়ের (লাল ও সবুজ) অটোরিকশা। তবে রিকশার কোনো সময়সীমা বেধে দেয়া না থাকলেও তাদের গ্যারেজে রিকশা উঠানোর জন্য সন্ধ্যার মধ্যেই সড়ক ছাড়তে হয়। ফলে উপার্জন হয় অনেক কম। এরইমধ্যে করোনায় জারি হওয়া লকডাউনে অটোরিকশা ও রিকশা চলাচল বন্ধ থাকায় রিকশাচালকরা পড়েছেন চরম বিপাকে। যদিও সিটি কর্পোরেশন থেকে বলা হচ্ছে, দেশে করোনার প্রাদুর্ভাবের পর নগরীর বিভিন্ন পেশার মানুষের মাঝে দফায় দফায় ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। সরকারি অনুদান ছাড়াও সিটি মেয়রের ব্যক্তিগত উদ্যোগে সহায়তা পেয়েছেন নগরবাসী। এ ব্যাপারে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশেনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোস্তাফিজ মিশু আগামী নিউজকে বলেন, নগরবাসীর মাঝে দফায় দফায় ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে।
অসহায়দের প্রতি দৃষ্টি রেখে সিটি মেয়রের ব্যক্তিগত উদ্যোগেও বিতরণ হয়েছে অনেক খাদ্য সামগ্রী। তবে এ বছর এখনো বাজেট হয়নি। বাজেট হলে অবশ্যই অসহায়দের প্রধান্য দিয়ে সঠিকভাবে বণ্টন করা হবে।
আগামীনিউজ/নাহিদ