রাঙ্গামাটিঃ চাকমা ভাষায় “বিজু এল বিজু গেল, ফাওন এল ফাওন গেল (বিজু এলো বিজু গেলো, ফালগুন এলো ফালগুন গেলো)”।
আজ ১২ই এপ্রিল থেকে আগামী ১লা বৈশাখ পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসব চলবে। কিন্তু বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশেও করোনার মহামারী আকার প্রকোপ বৃদ্ধিতে সারাদেশব্যাপী সবধরনের অনুষ্ঠান ও বৈশাখী মেলা বন্ধ করা হয়েছে। যে কারনে পার্বত্য পশ্চাৎপদ এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী আদিবাসীদের এবছরেও ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসব পন্ড হয়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসী জাতি-সত্ত্বাদের ঐতিহ্যবাহী মহোৎসব বৈ-সা-বি উৎসব।
বৈসাবি শব্দটি তিন অক্ষরে সীমাবদ্ধতা থাকলেও বঙ্গানুবাদ করলে অনেক বিশাল। বৈ- বৈসুক (ত্রিপুরা ভাষায়), সা-সাংগ্রাই (মার্মা ভাষায়) ও বি- বিজু/বিষ্ণু (চাকমা ও তংচংঙ্গ্যা ভাষায়) বলা হয় বৈসাবি। মূলতঃ বৈসাবি উৎসবটি বাংলা বছরের শেষ দু’দিন ২৯শে চৈত্র ও ৩০শে চৈত্র এবং বাংলা শুভ নববর্ষ পহেলা বৈশাখকে উৎসাহ উদ্দীপনায় ও হাসি আনন্দের মধ্যে দিয়ে দিন-গুলি মহাসমারোহে পালন করা হয়। এ উৎসবটি কেউ কেউ চৈত্র সংক্রান্তি হিসেবে উদযাপন করে থাকেন।
এ উৎসবটি পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত ১১টি আদিবাসী জাতিসত্ত্বা ১০ ভাষা-ভাষিদের অবিস্বরনীয় দিন হিসেবে আখ্যায়িত। বৈসাবি উৎসবটি ১২, ১৩ ও ১৪ই চৈত্র ৩ দিন ব্যাপী উদযাপিত করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জাতিসত্ত্বাদের এ বৈসাবি উৎসবটি শতবর্ষ ধরে সামাজিক রীতি-নীতিতে পালন করে আসছেন।
বৈসাবির ১ম দিনঃ
বৈসাবির প্রথম দিন বাংলা ২৯শে চৈত্র মাসের রাত ১২.০১মিনিট থেকে আদিবাসী কিশোর-কিশোরীরা নানা রং-বেরংরের ফুল সংগ্রহ করে নিজেদের বসত বাড়ী ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে ফুল সজ্জিত করে সাজিয়ে তোলেন। বৈসাবি ১ম দিনকে ত্রিপুরারা হারি বৈসু, মার্মারা সাংগ্রাই এবং চাকমা/তংচংঙ্গ্যারা ফুল বিজু/বিষ্ণু বলেন। প্রথম দিন থেকে শুর হতে থাকে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসব।
বৈসাবির ২য় দিনঃ
বৈসাবির ২য় দিনটি বাংলা ৩০শে চৈত্র। এদিনে পাহাড়ী আদিবাসী কিশোর-কিশোরী থেকে বৃদ্ধা-বণিতা পর্যন্ত সকলে মিলে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে। এদিনটিতে রান্নার আয়োজনের মধ্যে দিয়ে দুঃখ-বেদনা, হিংষা-বিদ্বেষ, জাতি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সংঘাত ও হানহানি ভূলে সবার মনে আনন্দের জোয়ার ভেসে উঠে। অতীতের ভুল বোঝা-বুঝির স্নান-গ্লানি দূর করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনকে সুদৃঢ় এবং সার্থক করতে এ প্রত্যাশা সবার কাছে। বৈসাবির ২য় দিনটি সবার জন্য উম্মুক্ত ও আনন্দের দিন। কেউবা ঢাক-ঢোল বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে, শহর থেকে শহুরে, পাড়া-মহল্লায় বাড়ী-বাড়ী গিয়ে রান্না করা খাদ্য দ্রব্য খেয়ে উৎসবটি পালন করেন। রান্না আইটেমের মধ্যে পাজন (বিভিন্ন মিশ্রিত করে রান্না করা), সেমাই, মিষ্টি, পাহাড়ী পিঠা, বিভিন্ন রকমের খাদ্য দ্রব্য এবং আদিবাসীদের একমাত্র চোলাই মদ (বাংলার পানি) আয়োজনে ভরপুর। এদিনটি ত্রিপুরারা বৈসুমা, মার্মারা আক্কেই ও চাকমা এবং তংচংঙ্গ্যারা মূল বিজু বলেন।
বৈসাবির শেষ দিনঃ
বৈসাবি শেষের দিনটি বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখকে বুঝায়। এদিনে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীরা সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠে নিজেদের বৌদ্ধ বিহার, উপাসনালয়, মন্দির ও গীর্জায় ধর্মীয় গুরুর নিকট দীক্ষা নিয়ে পুরাতন বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করেন। কেউ কেউ নিজ বাসা বাড়ীতে ধর্মীয় রীতি-নীতিতে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করে নেন। বৈসাবি শেষ দিনটি পাহাড়ী আদিবাসীরা ১লা বৈশাখকে সামনে রেখেই পাপকর্ম, মিথ্যাচার, অন্যায়-অত্যাচার, হিংসা-বিদ্ধেষ পিছনের দিকে ফেলে সত্য ও ন্যায়ের পথে সামনের দিকে অগ্রসর ও নতুন বছরকে বর্ষবরণের বৈসাবি উৎসবটি পালন করেন। ১লা বৈশাখটি শেষ দিন ও বিশ্রামের দিন বলে উল্লেখিত। পহেলা বৈশাখকে ত্রিপুরারা বিঁচি কাটাল, মার্মারা আটাদা ও চাকমা এবং তংচংঙ্গ্যারা গজ্জ্যা-পজ্জ্যা দিন (ঘরে বসে সময় কাটানো) বলেন।
বৈসাবি উৎসব পাহাড়ী আদিবাসীদের এক অবিস্নরনীয় ও তাৎপর্যের দিন। এলক্ষ্যে, গোঠা পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী আদিবাসীদের উৎসবটি বাৎসরিক মিলন মেলায় পরিণত হয়। বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় ও শহরের হরেক রকম খেলা-ধূলা, নাচ-গান, স্বাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন হয়। এ উপলক্ষে পাহাড়ী আদিবাসীদের প্রিয় খেলা নাদেং খেলা (লাঠিম), বলি খেলা, মার্মাদের পানি খেলা (জলকেলী), আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষায় নাটক মঞ্চস্থ হয়। বৈসাবি উৎসবটি পাহাড়ী আদিবাসী সমাজের শতবর্ষ থেকে সামাজিক রীতিনীতিতে উদযাপন করে আসছেন বলে জানা যায়। যত ঘনিয়ে আসে ততো পার্বত্য জনপদে আদিবাসীদের মধ্যে আনন্দের জোয়ার ও উৎসবের আমেজ মূখরিত হয়ে উঠে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের। ঐতিহ্যবাহী বৈ-সা-বি উৎসবটি পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা বিশ্বের ছড়িয়ে পড়–ক প্রতিটি জাতিসত্ত্বা সমূহের নিকট সম্প্রীতির বন্ধন বয়ে আনুক সুখ ও শান্তির ছায়া এ কামনায়।
এদিকে দেশের করোনার রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেজন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বৈসাবিসহ সবধরনের উৎসব সরকারি পর্যায়ে বন্ধের জন্য ঘোষনা করায় এবছরেও পাহাড়ীরা উৎসবটি পালন করতে পারছেন না। আগামী বছরের অপেক্ষায় রয়েছেন।
আগামীনিউজ/এএস