নারায়নগঞ্জঃ আর নয় পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারে, আগুন পান এখন রূপগঞ্জের নগরপাড়ায়। এমন সাইনবোর্ড দোকানের সাঁটানো দেখে ভীমড়ি। সন্ধ্যা তখন সাড়ে ৬ টা কি পৌনে ৭ টা। অজোপাঁড়াগাঁয়ের এ দোকানে লোকজনের জটলা। মনে হবে কি যেনো ঘটেছে। কিন্তু কাছে যেতেই চোখ কপালে উঠে গেলো। দোকানি নানারকম রঙ-বেরঙের মশলার পসরা সাজিয়ে কী যেন বিক্রি করছেন। একটু কাছে যেতেই চোখ পড়ল ব্যানারে বড় করে লেখা ‘হুজাইফা পান বাগান’।
পানের নামগুলো দেখে বিস্ময়ে নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘এ-ও কী সম্ভব?’ চকলেট পান, অরেঞ্জ পান, স্ট্রবেরি পান, লেমন পান, আইস পান, টক-মিষ্টি পান, ম্যাজিক পানসহ আরো বাহারি নামের দেখা মিললো এই পান বিতানে। তবে সেই তালিকায় রয়েছে ‘আগুন পান’। পানের পাশাপাশি হরেক রকমের চা-ও বিক্রি করা হয় রূপগঞ্জের নগরপাড়া এলাকার হুজাইফা ষ্টোরে।
আগুন পান নিয়ে কৌতুহলের বশে ভাবলাম দোকানির সঙ্গে কথা বলা যাক। কিন্তু সেই উপায় নেই। দোকানিকে ঘিরে রেখেছেন বিভিন্ন বয়সী ক্রেতা। একেকজন একেকরকম পানের অর্ডার দিচ্ছেন, আর দোকানি ঝটপট পান বানিয়ে ক্রেতাদের মুখে পুড়ে দিচ্ছেন। বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর দোকানের ভিড় কমলো। নাম জিজ্ঞেস করতেই বিনয়ের সঙ্গে জবাব দিলেন, আকতার হোসেন।
পানের ব্যবসার সঙ্গে আকতারের জড়িয়ে পড়া খুব বেশিদিনের নয়। তিন-চার বছর হবে। এর আগে তিনি একজন কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন মুদি দোকানে। তখন থেকেই স্বপ্ন বুনতেন নিজের একটি ব্যবসা দাঁড় করানোর। অতঃপর পান বিতান নিয়ে শুরু হয় তার স্বপ্নের পথচলা। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় কোন পান? প্রশ্নের জবাবে আকতারের এক কথায় উত্তর, ‘আগুন পান।’
আগুন পানের জন্য বিভিন্ন বয়সী ক্রেতাদের ভিড় জমলেও এই পান সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে তরুণ-তরুণীদের কাছে। জ্বলন্ত আগুনসহ মুখে পুড়ে দেওয়া পানের ভিডিও বন্ধুরা ধারণ করছেন মোবাইলে। পরবর্তীতে সেই ভিডিও স্থান পাচ্ছে ফেসবুক কিংবা ইনস্টাগ্রামে। তবে পানে আগুন দেওয়ার বিশেষত্বটা কী? আকতারের ভাষ্য মতে, ‘আগুন পানে ব্যবহার করা হয় দেশি-বিদেশি প্রায় ৩০ ধরনের মশলা। আগুনের আঁচে এই মশলাগুলো হালকা গলে যায় এবং নরম হয়। ফলস্বরূপ তা আগের তুলনায় বেশ মুখরোচক হয়ে ওঠে।’
বিভিন্ন ধরনের পানের পাশাপাশি পান বিতানে রয়েছে আকতারের নিজের বানানো পান, নাম টক-মিষ্টি পান। এছাড়াও আকতারের দোকানে রয়েছে পান বানানোর প্রায় ৬০টি আইটেম। রয়েছে ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানি মশলাও। সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পান বিক্রি করেন আকতার। তার প্রতিদিনের আয় প্রায় ২৫০০-৩০০০ টাকা। আকতার মনে করেন, পান বানানো একটি শিল্প। আর শিল্পীর সৃষ্টি তখনই পূর্ণতা লাভ করে যখন তা শিল্পীর হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
জ্বলন্ত আগুন পান মুখে ভরে তার স্বাদ নেয়ার বিষয়টিকে উপভোগ করতে রাজধানীর ডেমরা, মাদারটেক, নাসিরাবাদসহ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকেই ভিড় জমান নগরপাড়া বাজারে। এখানে আগুন পান ছাড়াও রয়েছে দিলখোশ পান, শাহী পান, বেনারশী পান, বউ জামাই পান, কিমাম পান, মুম্বাই পান ও কস্তুরী পানসহ বিভিন্ন নামের পান। পানের নামও বেশ বাহারি। সবচেয়ে দামি পানের নাম ‘লাভ ফরেভার’। এ ছাডা আছে চুইংগাম ও অন্যান্য উপাদান দিয়ে তৈরি চুইংগাম পান, স্ট্রবেরির জেলি দিয়ে তৈরি স্ট্রবেরি পান, বিভিন্ন স্বাদের ভ্যানিলা ক্রিম দিয়ে তৈরি ভ্যানিলা পান, অরেঞ্জ জেলি দিয়ে তৈরি অরেঞ্জ পান, চকলেট ক্রিম দিয়ে তৈরি চকলেট পান।
দেখা গেছে, দোকানের সামনে কাচের কৌটায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে পানের উপাদান। এর মধ্যে আছে চকলেট, বাদাম, নারকেল, গুলতান চাটনি, চকলেট ক্রিম, ভ্যানিলা ক্রিম, স্ট্রবেরি ও অরেঞ্জ জেলি, পেঁপে ভাজি, টুটিফুটি মোরব্বা, কোরমা, সুইট বল দানা, কালিজিরা, তবক, সুপারি, লবঙ্গ, একাঙ্গী, চুনসহ অর্ধশতাধিক উপাদান।
দোকানে বসে পান তৈরি করছেন আকতার হোসেন। আগুন পান তৈরি করতে একটি বড আকৃতির পান পাতার ওপর একে একে উপাদান সাজালেন। বিভিন্ন রকমের প্রায় ৪৫টি উপাদান দেওয়া শেষে সেগুলোর ওপর দিলেন একধরনের বিশেষ তরল পদার্থ। সেটিতে লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলেন। উপাদানগুলোতে আগুন জ্বলে ওঠার পর পান ভাঁজ করে নিজেই খাইয়ে দেন ক্রেতাদের। পানের পাশাপাশি রয়েছে তেঁতুল চা, মাল্টা চা, তুলশী চা, জলপাই চা, কালিজিরা চা, লেবু চা, পুদিনা পাতা চা, ককটেল চাসহ নানা রকমের চা।
পানে আগুন জ্বালিয়ে পরিবেশন কেন এমন উত্তরে আকতার আগামী নিউজকে বলছিলেন, ‘পানের উপাদানগুলোতে আগুন দিলে উপাদানগুলো ভালোভাবে মিশে যায়। ‘স্মোকি ফ্লেভার’ তৈরি হয়। দোকানের সামনে কথা হয় ডেমরা থেকে আগুন পান খেতে আসা ফরহাদ হোসেন ও রকীকুল হাসানের সঙ্গে।
তারা আগামী নিউজকে বলেন, ‘সুযোগ পেলেই আগুন পান খেতে আসি।’ আগুনসহ পান মুখে দিলে কেমন লাগে জানতে চাইলে নাসিরাবাদ থেকে আসা এক ক্রেতা বলেন, ‘পান মুখে দিলেই আগুন নিভে যায়। তখন গরম গরম খাবারের যে স্বাদ পাওয়া যায়, পানেও সে স্বাদ লাগে।’ তাই আগুন পান খেয়ে ঠোট রাঙ্গাতে চলে আসতে পারেন রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের নগরপাড়া বাজারে।
আগামীনিউজ/এএস