পাবনা জেলার ঈশ্বরদী সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসিল্যান্ড মমতাজ মহলের করা নানা রকম নিয়ম ও ব্যবস্থাপনার বেড়াজালে জমির দলিলের নাম খারিজ করতে ও খাজনা দিতে এসে চরম ভোগান্তি ও হয়রানিতে পড়ছেন জনগণ। টাকা ছাড়া মাসের পর মাস ঘুরলেও পাস হচ্ছে না খারিজ প্রস্তাব। হচ্ছে না মিস কেসের শুনানি। আর জমিতে দায়ের করা ১৪৪ ধারা মীমাংসা করার ক্ষেত্রেও পক্ষ এবং বিপক্ষের নিকট থেকে অফিস পিয়নের মাধ্যমে নেওয়া হয় সুবিধা। প্রায়ই খারিজ ও মিস কেস দায়েরকারীদের সঙ্গে করা হয় অসদাচারণ। আর খারিজসহ সকল কার্যক্রম অনলাইন ভিত্তিক হওয়ার সুযোগে এসিল্যান্ড অফিসের কর্মচারীরা ভয়াবহ আকারে ঘুষ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
একই সঙ্গে নিজে উপজেলা চত্বরে বিশাল বাসা বাড়িতে থাকলেও ভাড়া প্রদান করেন না। উপজেলা চত্বরে সরকারি বিশাল বাসার দোতলায় থাকলেও যোগদানের পর থেকেই বাসা ভাড়া দেন না। এ নিয়ে উপজেলা পরিষদের অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছে তীব্র সমালোচনা ও ক্ষোভ। ইউনিয়ন ভূমি অফিস, নাম খারিজ করতে দেওয়া ভুক্তভোগী ও উপজেলার বিভিন্ন কর্মকর্তা সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলোর দেওয়া তথ্য মতে, ইউনিয়ন ভূমি অফিসের মাধ্যমে দলিলের নাম খারিজের প্রস্তাব গেলে সেগুলো খারিজ করা হয় না। এমনকি গ্রহণ করেন না এসিল্যান্ড মমতাজ মহল। নিজের পছন্দমতো লোককে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। তিনি অফিস সহকারী সুমন আলীর মাধ্যমে সকল কাজ করেন। দলিলের নাম খারিজের জন্য চুক্তিমত সুমন আলী সর্বোনিম্ন এক হাজার করে টাকা নেন। তাকে বাদ দিয়ে খারিজ প্রস্তাব গেলে পাস হয় না। এমনকি খারিজের দরখাস্ত গ্রহণই করা হয় না।
সূত্রগুলো আরো জানায়, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে অফিস সহায়ক (পিয়ন) আবাই প্রামাণিককে লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে বদলি করা হয়। কিন্তু আবাই প্রামাণিক লক্ষ্মীকুন্ডা ভূমি অফিসে যোগদান। কিন্তু সেখানে তাকে কাজ করতে না দিয়ে ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তাকে মৌখিক নির্দেশের মাধ্যমে আবাই প্রামাণিককে নিজের কার্যালয়ে রেখেছেন। তার মাধ্যমেই আদালয়ে দায়ের করা ১৪৪ ধারার সকল মামলায় পক্ষ-বিপক্ষের সঙ্গে আতাত করা হয়। এতে লক্ষ্মীকুন্ডা ভূমি অফিসে লোকবল সংকটের কারণে ব্যবহৃত হচ্ছে দাপ্তরিক কার্যক্রম।
সূত্রগুলো মতে, এসিল্যান্ড ও অফিস সহকারী সুমন আলীসহ কয়েকজনের প্যানেলে খারিজের জন্য প্রায় ৪ হাজার প্রস্তাব দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে। সুমন আলী যেসব খারিজ প্রস্তাবের সুপারিশ করেন সেগুলোই পাস করেন এসিল্যান্ড।
গত ৩ মার্চ (মঙ্গলবার) সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ঈশ্বরদী সহকারী কমিশনার (ভূমি) মমতাজ মহলের কার্যালয় সামনে অবস্থান করে দলিলের নাম খারিজ ও মিস কেসের আবেদনকারীদের সঙ্গে কথা বললে এসিল্যান্ড অফিসের ভয়াবহ অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির চিত্র বেড়িয়ে আসে।
উপজেলা মুলাডুলি গ্রামের ঝন্টুর স্ত্রী হাসিয়া বেগম, আবুল কাশেমের স্ত্রী মুন্নি ও তুহিনের স্ত্রী হাসি বেগম, লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নের মৃত জফির উদ্দিনের ছেলে জালাল উদ্দিন, শাহাদত হোসেন জানান, প্রায় এক বছর পূর্বে তারা দলিলের নাম খারিজের জন্য অনলাইনে আবেদন করেন। কিন্তু এখনো তাদের শুনানি হয়নি। প্রায়ই তারা অফিসে এসে ঘুরাঘুরি করতেন। শেষে নিরুপায় হয়ে অফিসের কয়েকজনকে টাকা দিয়েছেন। টাকা গ্রহণকারী সকালে আসতে বলেন। কিন্তু বিকেলে হয়ে যাচ্ছে এখনও কাজ হয়নি বলে বসে আছি। টাকা ছাড়া কোনো কাজই হয় না এই অফিসে। টাকা না দিলে দিনের পর দিন ঘুরতে হয়। আর কোনো বিষয়েই এসিল্যান্ডের সঙ্গে কথায় বলা যায় না। তিনি খুবই রাগী। কিছু জানতে গেলেই ক্ষিপ্ত হয়ে যান। তখন অফিসের অন্যান্যরা আমাদের বের করে দেন।
পাবনা সদর থানার ইসলামগাতি এলাকার মান্নান শেখের ছেলে সুমন শেখ জানান, ৮ মাস আগে দায়ের করা মিস কেস দায়ের করা হয়। অনেক ঘুরাঘুরি করে ও চুক্তিমতো টাকার দেওয়ার পর শুনানির তারিখ পেয়েছি। তাই বসে আছি। এখানে টাকা ছাড়া হয়রানি আর ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
উপজেলার পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামের আব্দুর বারী মোল্লা জানান, এসিল্যান্ড মমতাজ মহল খুবই বদমেজাজী। তাদের নাম খারিজের জন্য মিস কেস দাখিল করা হয়। কিন্তু এসিল্যান্ড অজ্ঞাত কারণে তা গ্রহণ না করে অনেকদিন ঘুরিয়েছেন। বাধ্য হয়ে পাবনা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নিকট আবেদন করা হয়েছে।
কৃষিতে রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত কৃষাণী নুরুন্নাহার বেগম অভিযোগ করে জানান, তিনি বেশ কিছুদিন আগে জমির খাজনা খারিজের জন্য এসিল্যান্ড মমতাজ মহলের অফিসে যান। তিনি তার অফিস সহকারী সুমনের আলীর মাধ্যমে ২ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। সেই টাকা না দেওয়ায় এসিল্যান্ড তার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেন। পরে নুরুন্নাহার বেগম পাবনা জেলা প্রশাসককে বিষয়টি অবগত করেন। এরপর আটঘরিয়া এসিল্যান্ডকে দায়িত্ব দিয়ে তার খাজনা খারিজ সম্পূর্ণ করেছেন।
ঈশ্বরদী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ আব্দুর রকিব অভিযোগ করে জানান, বর্তমান এসিল্যান্ড মমতাজ মহল খুবই বদমেজাজি। মানুষকে খুবই হয়রানি করেন। তাকে অনেকদিন ধরে অহেতুক কারণে হয়রানি করেছেন। ঈশ্বরদীর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এসিল্যান্ড হিসেবে মমতাজ মহলকে রাখায় ঠিক না।
উপজেলা হিসার রক্ষণ অফিস সূত্রে জানা যায়, এসিল্যান্ড হিসেবে মমতাজ মহল ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর ঈশ্বরদীতে যোগদান করেন। তার বেতন থেকে বাসা ভাড়া বাবদ খরচ কর্তন করা হয় না। বিষয়টি পূর্বের ইউএনও আহমেদ হোসেন ভূইয়াকে অবগত করা হয়। কিন্তু এসিল্যান্ডের বাসার ভাড়ার বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য ইউএনও মৌখিকভাবে নির্দেশ দেন। এরপর থেকে এসিল্যান্ডের বাসার বিষয়ে আর কোনো খোঁজ নেওয়া হয়নি। উপজেলার ভিতরে একটি দোতলা বাসায় কিভাবে থাকেন তা তাদের জানা নেই। তবে বিষয়টি নিয়ে সবার মাঝেই কৌতুহল ও সমালোচনা হয়।
দী সহকারী কমিশনার (ভূমি) মমতাজ মহল জানান, কাজ করতে গেলে জনগণ এসব বলবেই। কোনো কিছুই নিয়মের বাইরে করা হয় না। কারও থেকে বিনা কারণে কোনো কিছু গ্রহণ করেন না বলে দাবি করেন। তিনি আরো জানান, খারিজের কাজ চলমান প্রক্রিয়া। এটি আটকিয়ে যাবেই। তবে দুই মাস প্রশিক্ষণে থাকায় আটকে যাওয়া আবেদনের পরিমাণ বেড়েছে।
ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিহাব রায়হান জানান, এসিল্যান্ডের নামে বার্ষিক চুক্তিতে বাসা বরাদ্দ নেই। তাই বেতন থেকে ভাড়া কর্তন না হলেও অন্যভাবে হয়তো এসিল্যান্ড ভাড়া পরিশোধ করেন।
আগামীনিউজ/রাকিব/মাসুম