বাকৃবির উদ্ভাবন

ছত্রাক প্রতিরোধী ও উচ্চফলনশীল পাঁচটি সরিষার জাত উদ্ভাবন

তানিউল করিম জীম, বাকৃবি প্রতিনিধি জুন ২৭, ২০২২, ০৩:৩৬ পিএম

ময়মনসিংহঃ ছত্রাকজনিত রোগ অলটারনারিয়া ব্লাইট প্রতিরোধী এবং উচ্চফলনশীল পাঁচটি সরিষার জাত উদ্ভাবনে সফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক। দীর্ঘ পাঁচ বছরের গবেষণায় এ সাফল্য পেয়েছেন তারা। উদ্ভাবিত সরিষার জাতগুলো হলো বাউ সরিষা-৪, বাউ সরিষা-৫, বাউ সরিষা-৬, বাউ সরিষা-৭ এবং বাউ সরিষা-৮। জাতগুলোর গড় ফলন হেক্টর প্রতি ২ দশমিক ৫ টন যা প্রচলিত অন্যান্য জাতের তুলনায় ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ বেশি। জাতগুলো সারাদেশে চাষের উপযোগী এবং এদের জীবনকাল ৯০ থেকে ৯৫ দিন। কৃষকরা এ জাতগুলো চাষ করে  প্রচলিত জাতের তুলনায় প্রায় দেড় থেকে দুই গুণ আর্থিকভাবে লাভবান হবেন।

সোমবার (২৭ জুন) সকাল ১০ টায় বাকৃবি সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান গবেষক দলের প্রধান বাকৃবির জেনেটিক্স এন্ড প্লান্ট ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আরিফ হাসান খান রবিন।

গবেষক ড. আরিফ বলেন, দেশে সরিষা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় বাঁধা হলো নানান রোগ ও পোকার আক্রমণ যার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো অলটারনারিয়া ব্লাইট রোগ। এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। রোগটি এককভাবে তেলবীজের ফলন ৩০-৫০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে জমির শতভাগ ফসল নষ্ট করে দেয়। নতুন উদ্ভবিত জাতগুলো অলটারনারিয়া ব্রাইট রোগের প্রতি উচ্চমাত্রায় সহনশীল। উদ্ভাবিত সরিষার জাতগুলো বাউ সরিষা-৪, বাউ সরিষা-৫, বাউ সরিষা-৬, বাউ সরিষা-৭ এবং বাউ সরিষা-৮ । ২০১৭ সালে বাকৃবি রিসার্স সিস্টেমের সহায়তায় এ গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়। পরে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণলয়ের অর্থায়নে বিগত তিন বছরের চলমান এ গবেষণা ২০২২ সালের জুন মাসে শেষ হবে।

গবেষক জানান, দেশে বর্তমানে প্রায় ০.৩ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়।  চাষকৃত উল্লেখযোগ্য জাতগুলো হলো বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৬, বারি সরিষা-১৮, বিনা সরিষা-৯, বিনা সরিষা-১০। আবাদকৃত তেলবীজ ফসলসমূহের মধ্যে সরিষা দখল করে আছে ৬৭% কৃষিজমি। যেখানে বাদাম, সয়াবিন এবং তিলের চাষ হয় যথাক্রমে ১২,১১ এবং ১০ শতাংশ জমিতে। পুষ্টিগুণ, স্বাদ ও ঝাঁঝের কারণে রসনাবিলাসের পাশাপাশি ভোজ্য তেলের চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করছে সরিষা। সরিষার তেলবীজে জাতভেদে ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ তেল থাকে। এ উৎপাদন দেশের মোট চাহিদার মাত্র ১৫-২০ শতাংশ পূরণ করছে। ভোজ্য তেল আমদানিতে বাংলাদেশেকে প্রতিবছর ২ হাজার ১’শ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়। 

সরিষার উপকারিতা সম্পর্কে গবেষক বলেন, সরিষার তেলে মনোআনসেচুরেটেড এবং পলিআনসেচুরেটেড ফ্যাটি এসিড থাকায় রক্তে ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ে এবং খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমতে থাকে। এছাড়াও ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিডের একটি আদর্শ অনুপাত(২.৫ঃ১) থাকায় এটি স্বাস্থ্যের জন্য আতি উপকারী। এছাড়াও সরিষার তেল হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতেও সাহায্য করে।

গবেষক আরো জানান, উদ্ভাবিত জাত পাঁচটি ব্রাসিকা জুনসিয়া প্রজাতির অন্তর্ভূক্ত। অতিরিক্ত আদ্রতাতেও ১০০ দিনের মধ্যে দানা পরিপক্ব হতে সক্ষম। আগাম ও স্বল্পজীবনকালের আমন ধানের চাষের পর এই উচ্চফলনশীল জাতের সরিষা চাষ করে কৃষকেরা বোরো ফসল ধরতেও সক্ষম হবেন। সেইসাথে এই তেলের আবাদের মাধ্যমে দেশে ভোজ্যতেলের সংকটও কমে যাবে। এ ক্ষেত্রে সরকার আমন ধানের পরে সরিষা চাষে ভর্তুকির দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। আগামী দুই থেকে তিন বছরে সরিষার উৎপাদন দুই-তিন গুণ বাড়াতে এ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

অধ্যাপক ড. এ. বি.এম. আরিফ হাসান খান রবিন নিউজিল্যান্ডের ম্যাসি বিশ্ববিদ্যালয় হতে ২০১১ সালে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ায় সুনচুন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে পোস্ট ডক্টরেট গবেষণা সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি সরিষা, ধান, গম ও মিষ্টি আলুর উন্নত জাত উদ্ভাবন নিয়ে গবেষণা করছেন। অধ্যাপক রবিন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হতে ২০১৮, ২০২০ এবং ২০২২ সালে ‘সেরা প্রকাশনা এওয়ার্ড’ প্রাপ্ত হন। এছাড়া ২০২২ সালের বাউরেসের বার্ষিক গবেষণা অগ্রগতি কর্মশালায় সেরা ‘প্রবন্ধ উপস্থাপক’ এওয়ার্ড প্রাপ্ত হন। 

এমবুইউ