জাককানইবি মেডিকেল সেন্টারে সেবার বেহাল দশা, শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি চরমে

জাককানইবি প্রতিনিধি নভেম্বর ১৪, ২০২১, ১১:৫৮ এএম
ছবিঃ সংগৃহীত

‘ব্যাথার দান’৷  এটি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র মেডিকেল সেন্টারের নাম। নাম ‘ব্যাথার দান’ হলেও মেডিকেল সেন্টারটিতে তেমন কোনো সেবা মেলেনা। নেই কোনো আধুনিকতার ছোঁয়া। সময়মতো চিকিৎসা সেবা তো মেলেই না, চিকিৎসক সংকটে জর্জরিত প্রথম থেকেই। প্রায় ৮,০০০ শিক্ষার্থীর জন্য চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৪ জন। প্রতি ২,০০০ জন শিক্ষার্থীর জন্য চিকিৎসক মাত্র ১ জন। তার ওপর নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আগেই চলে যান চিকিৎসক। সব চিকিৎসক আবার ঠিকমতো আসেন না। সব ওষুধপত্র বিনামূল্যে দেয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ ওষুধ কিনতে হয় বাইরে থেকে। নেই রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা, ইসিজি কক্ষ ও প্যাথলজি ল্যাব।  এতসব সমস্যা ও অভিযোগ নিয়েই চলছে চিকিৎসা কেন্দ্রটি।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, মেডিকেল সেন্টারটিতে চিকিৎসাসেবার কিছুই নেই। মেডিকেল সেন্টারে গিয়ে সময়মতো চিকিৎসা পাওয়া যায়না, নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আগে চিকিৎসক চলে যান, নাপা-প্যারাসিটামল ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়না, লিখে দেওয়া অধিকাংশ ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়,ডাক্তার ও স্টাফরা দায়িত্বশীল আচরণ করেন না।

জাককানইবির মেডিকেল সেন্টারে ‘সর্বরোগের মহৌষধ প্যারাসিটামল’। এইধরনের একটি কথা প্রচলিত আছে ক্যাম্পাসে। শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘যেকোনো অসুস্থতায় প্যারাসিটামলই একমাত্র ওষুধ। অন্যান্য ওষুধ থাকলেও পূর্ণাঙ্গ ডোজের ওষুধ মেলা ভার। সাত দিনের ওষুধ লিখে দিয়ে দুই দিনের ওষুধ দিয়েই খালাস তারা।’

তবে ব্যাথার দানের সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. এম এম আশরাফ উদ্দিন তালুকদার বলেন, ‘এ তথ্যটিতে কিছু সমস্যা আছে। আমরা তুলনামূলক গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধ প্রদান করি যার মূল্য বেশি হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ ডোজ দেয়া যায় না। তবে মানসম্মত ওষুধ দেয়া হয় এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।’

শাহরিয়ার চৌধুরী নামের এক শিক্ষার্থী জানান, ব্যাথার দানে গেলে অধিকাংশ সময়ই হতাশ হয়ে ফিরতে হয়। হয় চিকিৎসক থাকেন না, অথবা চিকিৎসক থাকলেও পর্যাপ্ত সেবা দেন না। সামান্য অসুস্থতাতেও প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেন না তারা। পাঠিয়ে দেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অথবা ময়মনসিংহ মেডিকেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটা জায়গায় আমরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকার পরও স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত, বিষয়টা সত্যিই লজ্জাজনক।

জানা যায়, মেডিকেল সেন্টারটিতে দায়িত্বরত চারজন ডাক্তারের মধ্যে নিয়মিত উপস্থিত থাকেন মাত্র দুইজন। গভীর রাতে বা অফিস সময়ের বাইরে সার্বক্ষণিক চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য কোনো চিকিৎসক নেই এখানে। দুইজন আবাসিক চিকিৎসক নিয়োগ দেয়ার নিয়ম থাকলেও শূন্য পড়ে আছে পদ। পাঁচ বছর পূর্বে যে সংখ্যক চিকিৎসক ছিলেন, শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হলেও বাড়েনি চিকিৎসক। বাজেটেরও একই দুরবস্থা। ওষুধ সরবরাহের জন্য পাঁচ বছর আগে বাজেট ছিল ৭৫ হাজার, যা এখনও একই রয়েছে। দুইজন নার্সের মধ্যে একজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকায় একজন দিয়েই চলছে কাজ।

জানা গেছে, করোনার সময়ে প্রয়োজনীয় কিছু সরঞ্জাম কেনার জন্য বরাদ্দ পেয়েছিল মেডিকেল সেন্টার ব্যাথার দান। কিন্তু কোনো সরঞ্জামই কেনা হয়নি বলে জানান সিনিয়র মেডিকেল অফিসার আশরাফ। তিনি বলেন, যেহেতু ওইসময় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল তাই কোনোকিছু কেনা হয় নি। কর্তৃপক্ষ আবার সেই টাকা ফেরত নিয়েছে। তবে আমাদেরকে সেখান থেকে কিছু টাকা দিবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তারা।
 
প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কয়েকটি সরঞ্জাম থাকলেও নেই কোনো ইসিজি কক্ষ, প্যাথলজি ল্যাব। আবার ইসিজি মেশিন, আল্ট্রাসনোগ্রাম যন্ত্র থাকলেও জনবলের অভাবে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশেই চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম। পড়ে আছে রক্তমাখা গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা।

পরিচ্ছন্নতাকর্মী নেই একজনও। এ বিষয়ে মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন বলেন, “আমরা নিজেদের অর্থব্যায়ে, নিজেদের তত্ত্বাবধানে বাইরে থেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়ে এসে মাঝে মাঝে মেডিকেল সেন্টারটি পরিষ্কার করছি। অনেক সময় বাধ্য হয়ে রক্ত মাখা কাপড়, গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা আমাদের নিজেদেরও পরিষ্কার করতে হয়।”

সিনিয়র মেডিকেল অফিসার আবুল খায়ের মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, “প্যাথলজি সেবা দেওয়ার জন্য আমাদের কোনো টেকনোলজিস্ট নেই, নেই আধুনিক যন্ত্রপাতি। এছাড়া আমাদের মেডিকেল সেন্টারটিতে নিয়ম অনুযায়ী ৪ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী থাকার কথা থাকলেও একজনও নেই। আমাদের পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে শিক্ষার্থীদের হয়তো শতভাগ সার্ভিসটা দিতে পারিনা। জনবল বাড়ানোর জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বার বার অবহিত করেছি।”

মেডিকেল সেন্টার ‘ব্যাথার দান’-এর সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে আরেক সিনিয়র মেডিকেল অফিসার  ডা. এম এম আশরাফ উদ্দিন তালুকদার বলেন, “পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই, নেই পর্যাপ্ত নার্সও। সর্বসাকুল্যে স্টাফ আছেন মাত্র সাত জন। টেকনিশিয়ান তো নেইই। ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন আছে, কক্ষ নেই। টেকনিশিয়ানের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্যাথলজি ল্যাব নেই। স্থান সংকুলান জনিত সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে প্রথম থেকেই। নতুন ভবন নির্মাণের আশ্বাস দিলেও বাস্তবায়নের বালাই নেই। প্রশাসনের কোনো তদারকি নেই৷ সর্বোপরি এই মেডিকেল সেন্টারের সামগ্রিক অবস্থা খুবই বাজে। 

ছাত্র উপদেষ্টা তপন কুমার সরকার বলেন, “নতুন হল খোলা হলে প্রায় সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে অবস্থান করবে। যেকোনো মূহুর্তে যে কারও সমস্যা হতে পারে। আমি চাই মেডিকেল সেন্টারটি যেন ২৪ ঘন্টা খোলা রাখা হয়। পাশাপাশি যেন এর সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হয়।”

রেজিস্ট্রার কৃষিবিদ ড.মোঃ হুমায়ুন কবীর সমস্যার কথা  স্বীকার করে বলেন, “আমরা সামনে মেডিকেল সেন্টারকে আরো গতিশীল ও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিচ্ছি।”

উপাচার্য প্রফেসর ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘মেডিকেল সেন্টার ব্যথার দান-এ কিছুই করতে পারিনি। সদিচ্ছা ছিল, কিন্তু দক্ষ টেকনিশিয়ান নিয়োগ দিতে না পারায় তেমন কিছু করা সম্ভব হয় নি। এছাড়াও পর্যাপ্ত চিকিৎসক নাই, নার্সও নাই। সর্বোপরি এটির অসহায় অবস্থা। এসব পদে জনবল নিয়োগের চেষ্টা থাকলেও নানা প্রতিবন্ধকতায় সেগুলো সম্ভব হয় নি।’’

আগামীনিউজ/নাসির